খালেদা জিয়া চলে গেলেন: সন্দেহ, ষড়যন্ত্র ও বাংলাদেশের অসমাপ্ত রাজনীতি
নয়ন বিশ্বাস রকি :
খালেদা জিয়া চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শোকের ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরস্থায়ী এক সন্দেহ, ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার নির্মম গেইম-পলিটিক্সের প্রতীক হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুর দিন, জানাজা, এমনকি রাষ্ট্রীয় আচরণ পর্যন্ত যেন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। ফলে খালেদা জিয়ার মৃত্যুদিন নিয়েও এদেশে চিরকাল সন্দেহের চোখে তাকানো হবে।
ইতিহাসে মুঘলরা উত্তরাধিকারীদের চোখ অন্ধ করে দিত। কারণ ইসলামি ব্যাখ্যায় অন্ধ ব্যক্তি শাসক হতে পারে না। সেই সূত্রেই মুঘল ইতিহাস ভরা ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের চোখ হারানোর রক্তাক্ত অধ্যায়ে। আধুনিক বাংলাদেশে সেই চিত্র ভিন্ন হলেও পদ্ধতি একই—ক্ষমতার পথে প্রতিপক্ষকে অকার্যকর করে ফেলা। তারেক জিয়াকে নানা শর্ত মেনে দেশে ফিরতে হয়েছে। কবে খালেদা জিয়া মারা যাবেন, কবে তাঁর জানাজা হবে—সেটিও যেন নির্ধারিত ছিল গেইম মেকারদের ইচ্ছায়।
অতীতের গেইম মেকাররাই যেমন নির্ধারণ করেছিল ১৫ আগস্টকে—যেদিন শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন—সেই দিনটিকে জন্মদিনের উৎসবে পরিণত করা হবে। এদেশের এন্টি-মুক্তিযুদ্ধ ও পরাজিত শক্তির কাছে ১৫ আগস্ট ‘নাজাত দিবস’। সেই দিনে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করে তারা পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছিল। ৩২ নম্বরে লুঙ্গি ড্রান্স গানের তালে উদ্দাম নৃত্য ছিল বাংলাদেশের বিভাজনের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনি হুজুরদের সংজ্ঞায় পর্দানশীন ছিলেন না, নামাজ-কালামেও ছিলেন না নিয়মিত। তবু তিনি এদেশের ইসলামি গোষ্ঠীর কাছে প্রিয় ছিলেন। এটি তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুশীলনের কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। ইতিহাস বলে, ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনে দাঁড়ালে পাকিস্তানের আলেম সমাজ তাঁকে সমর্থন করেছিল এই যুক্তিতে যে বড় পাপ ঠেকাতে ছোট পাপ জায়েজ। বড় পাপ ছিল আইয়ুব খান, যিনি মুসলিম পার্সোনাল ল’ সংস্কার করেছিলেন। ঠিক সেই রাজনৈতিক যুক্তিতেই নারী নেতৃত্ব হারাম জেনেও আলেম সমাজ খালেদা জিয়াকে সমর্থন করেছিল—মুজিব কন্যার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে।
খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেটিই বহন করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে পাকিস্তান শব্দটি এড়িয়ে গিয়ে ‘হানাদার বাহিনী’ বলা হতো। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কার্যত অস্বীকার করা হয়েছিল। সামান্য কোনো রাজনৈতিক ভুলের কারণেই কি চিহ্নিত রাজাকার ও আলবদরদের মন্ত্রী বানানো সম্ভব? এখানে আদর্শ নয়, রাজনীতিই মুখ্য ছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে বিপুল গণভিত্তি তৈরি হয়েছিল, পাকিস্তান ভাঙার পর তার বিপরীতে স্বাভাবিকভাবেই একটি এন্টি-ভোট তৈরি হয়। সেই ভোট পেতেই বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হয়েছে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের একজন নেত্রীকে বলতে শোনা গেছে—আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কোরবানি থাকবে না, মসজিদে উলুধ্বনি হবে, ভারত দেশ দখল করে নেবে। ভয় ও বিভাজনের রাজনীতিই ছিল বিএনপির প্রধান পুঁজি।
খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে রাজনীতিতে রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকার ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। তারেক জিয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয় অশুভ রাজনীতি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল সেই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ। সেদিন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী সংকটের সূচনা ঘটে।
আইএসআই ঘনিষ্ঠতা, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র খালাস—এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার শাসনেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে অশুভ ছায়া নেমে আসে। তবু তিনি হতে পারতেন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির একটি বিকল্প নেতৃত্ব। তিনি মোল্লাদের সামনে নতজানু ছিলেন না, কিন্তু ধর্মের কার্ড তিনি খেলেছেন অবিরাম। যদিও সত্য হলো—এই দেশে সবাই ধর্মের কার্ড খেলেছে; মুজিব, জিয়া, এরশাদ, হাসিনা—সবাই।
আজ খালেদা জিয়া সব কিছুর ঊর্ধ্বে। একদিন আমরাও সবাই যাবো। আজও শেখ হাসিনা জীবিত—এটি স্বস্তির বিষয়। কিন্তু তাঁকে কেবল দলের নেত্রী নয়, দেশের কান্ডারী হতে হবে। অতীতের রাগ ও ক্ষোভ ভুলে সেই যাত্রা শুরু হতে পারে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে শেখ হাসিনার শোক প্রকাশের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শত্রু নয়। পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই দুটি প্রধান দল থাকে। ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ তৈরির নামে মিডিয়া ও সুশীল চক্রের ষড়যন্ত্র যে কত বড় নৈরাজ্য ডেকে আনে, তা জনগণ ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছে।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বোধ তৈরি হোক—দেশের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই কান্ডারী হতে পারে। আমরা সেটিই দেখতে চাই।
খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নয়ন বিশ্বাস রকি
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

















