Logo

ক্যাম্পাস    >>   একটি উজ্জ্বল জীবনের অসমাপ্ত যাত্রা; তীর্থ বিশ্বাসের শেষ সকাল

একটি উজ্জ্বল জীবনের অসমাপ্ত যাত্রা; তীর্থ বিশ্বাসের শেষ সকাল

একটি উজ্জ্বল জীবনের অসমাপ্ত যাত্রা; তীর্থ বিশ্বাসের শেষ সকাল

কৃষ্ণ কুমার শর্মা, প্রজ্ঞা নিউজ, নিউ ইয়র্ক:

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এক নীরব ভোরবেলা। ঠিক তখনই, যখন আকাশ ধীরে ধীরে সোনালি আলোয় ঝলমল করতে শুরু করেছে, ঘটে গেলো এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা—এক নির্জন হাইওয়েতে মুখোমুখি সংঘর্ষ তিনটি গাড়ির। সেই গাড়িগুলোর একটিতে ছিলেন তীর্থ বিশ্বাস, এক তরুণ বাংলাদেশি, যার স্বপ্ন, মেধা আর ভবিষ্যতের দিগন্ত মুহূর্তেই থেমে গেলো—এক অপ্রস্তুত, নির্মম বাস্তবতায়।

মাত্র ৩২ বছর বয়সী তীর্থ ২০২০ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি চট্টগ্রামের সন্তান—পরিবারের গর্ব, বন্ধুবান্ধবের নির্ভরতার আশ্রয়। মাত্র গত বছরই তিনি বিয়ে করেছিলেন চট্টগ্রামেরই আরেক গুণী কন্যা, রিথিকা চৌধুরীকে—একজন দক্ষ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাদের ছোট্ট সংসারটি ছিল ভালোবাসা ও স্বপ্নে মোড়া—তীর্থ পড়াশোনা করছিলেন অস্ট্রেলিয়ার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর রিথিকা নিজের অবস্থান পোক্ত করছিলেন কর্পোরেট টেকজগতে।

দুর্ঘটনাটি ঘটে ভোর পাঁচটার কিছু আগে। তিনটি গাড়ির তীব্র ধাক্কায় তীর্থের মাথায় মারাত্মক আঘাত লাগে। স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলেও কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

চট্টগ্রাম থেকে কান্নার সাড়া

খবরটি ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের অলিগলিতে। মা তখন ভিডিও কলে কথা বলার প্রস্তুতিতে, বাবার মুখে স্তব্ধতা—যিনি চট্টগ্রাম জেলা বারের একজন সম্মানিত আইনজীবী। জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব এখন শুধুই ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, কিছু সার্টিফিকেট, আর অসীম শোক।

একটা ঘর, যেখানে ছিল ভালোবাসার হাসি

রিথিকা এখনো বাকরুদ্ধ। কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কথা বলেননি। তাঁর পাশে থাকা এক কলকাতার ছাত্র জানান,
“তারা দু’জন একসাথে থাকলে মনে হতো, ঘরটাই হাসছে। তীর্থের হাতের চিংড়ি মালাই কারি ছিল সবার প্রিয়।”
তীর্থের শেষ মেসেজটি এখনও খোলা হয়নি — লেখা ছিল:
“ফিরে এলেই কফি রেডি। ভালোবাসি।”

সামাজিক নেতৃত্ব ও প্রগতির এক দীপ্ত প্রতীক

বাংলাদেশে তীর্থ ছিলেন এক উদ্যমী কর্মী। তিনি ছিলেন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ল’ স্টুডেন্টস (NILS) এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সামাজিক ন্যায়বিচার ও অধিকার নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুতে NILS এক শোকবার্তায় জানায়:
“তীর্থ ছিলেন এক উজ্জ্বল দীপ্তি — মেধা আর মননের এক অপূর্ব মিশ্রণ।”

তীর্থ ছিলেন শিকড়ে-গাঁথা একজন মানুষ। অস্ট্রেলিয়ার মতো দূরদেশেও তিনি বাংলা নববর্ষ ও দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে। দরিদ্রদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহ করেছেন, এমনকি এক বন্ধুর দুর্ঘটনার পর রোড সেফটি ক্যাম্পেইনও চালিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুই আজ তাঁর নিজের গন্তব্য হয়ে দাঁড়াল।

অকস্মাৎ মৃত্যু ও অনন্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি

তীর্থ বিশ্বাসের অকালমৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—জীবন এক অনিশ্চিত, রহস্যময় যাত্রা।
ভগবদ গীতা-তে বলা হয়েছে:
“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিত্‌… আত্মা কখনও জন্ম নেয় না, কখনও মরে না।”
আত্মা চিরন্তন, অবিনশ্বর। তীর্থ বিশ্বাস শারীরিকভাবে হয়তো আর নেই, কিন্তু তাঁর আত্মা, তাঁর স্মৃতি আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকবে—ভালোবাসা, কর্ম এবং অবদানের মধ্য দিয়ে।

ভালোবাসা ও শাশ্বত সত্যের এক মূর্ত প্রতীক

তীর্থের চলে যাওয়া আমাদের শিখিয়ে যায়—জীবন একটি সংক্ষিপ্ত সফর, যার একমাত্র মূল মন্ত্র ভালোবাসা।
ভগবদ গীতায় বলা হয়েছে:
“উত্তম তম প্রেমাত্মক প্রেম। প্রেমাত্মক বিশ্বাস এবং প্রভু যা প্রতিপাদিত হয়।”

তীর্থ সেই প্রেমেরই মূর্ত প্রতীক ছিলেন—যিনি আশেপাশের সবাইকে ভালোবাসতেন স্নেহ আর শ্রদ্ধা দিয়ে। তাঁর হৃদয়ের স্পন্দনে ছিল মানবতা, সহমর্মিতা এবং আত্মবিশ্বাসের নিরবচ্ছিন্ন জ্যোতি।

চিরন্তন শান্তি ও আত্মার উজ্জ্বলতা

তীর্থ বিশ্বাসের জীবনের অভ্যন্তরীণ ছন্দ—তাঁর আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা, এবং হাসিমাখা জীবনদর্শন আমাদের শিখিয়ে যায়:
শারীরিক মৃত্যু দেহের হয়, আত্মার নয়।
তীর্থ আমাদের হৃদয়ে, আমাদের প্রতিটি কাজের মাঝে, তাঁর স্বপ্নের প্রতিধ্বনিতে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আলোয় মোড়া এক আত্মার প্রতি নিঃশব্দ কুর্নিশ।
ভালো থেকো, তীর্থ।

কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস | কলামনিস্ট, প্রজ্ঞা নিউজ, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র