Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   জীবনের কিছু কথা ও অন্তিম শয্যায় অনন্ত বিশ্রাম—চিত্রা রোজারিও

জীবনের কিছু কথা ও অন্তিম শয্যায় অনন্ত বিশ্রাম—চিত্রা রোজারিও

জীবনের কিছু কথা ও অন্তিম শয্যায় অনন্ত বিশ্রাম—চিত্রা রোজারিও

জীবনের কিছু কথা ও অন্তিম শয্যায় অনন্ত বিশ্রাম

“স্বর্গীয় নাগরিত্বে তীর্থযাত্রীর মত
খৃষ্টের নেতৃত্বে এবং পবিত্রাত্মার একত্বে
যাচ্ছি মোরা পিতার সমীপে ।।”

জন্ম থেকে স্বর্গস্থ হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত খৃষ্টান হিসেবে আমরা এই পৃথিবীতে এক মহা তীর্থযাত্রার যাত্রী হয়ে সময় অতিবাহিত করছি। আমাদের প্রতি ঈশ্বরের যে মহা পরিকল্পনা, তা হলো—আমরা যেন ঈশ্বরকে চিনতে ও জানতে পারি, তাঁর দেখানো পথে চলতে পারি, এক ঈশ্বরেরই পূজা করি, তাঁর সেবা করি এবং মৃত্যুর পর স্বর্গে তাঁর সাথেই থাকতে পারি। এই চরম উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমাদের পৃথিবীতে—জীবিতদের দেশে—তীর্থযাত্রায় আমরা সমাসীন।
এই দীর্ঘ যাত্রাপথে আমরা জীবনের প্রতিটি ধাপে ঈশ্বরের পরিকল্পনা জানতে সচেষ্ট হই এবং সহজ-সরল পথে থেকে খৃষ্টীয়ভাবে চলার চেষ্টা করি। জীবনে যখনই সমস্যার সম্মুখীন হই, তখন ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করি এবং তাঁর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখে জীবন যাপন করি।
এই পৃথিবীতে বিশ্বাস ও আশার তীর্থযাত্রা শুরু হয়েছিল সেদিন, যেদিন হস্তার্পণ সাক্রামেন্ট গ্রহণ করে পবিত্র আত্মার শক্তির আলোতে বলীয়ান হয়ে পথচলা শুরু করেছিলাম। একে একে কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে এখন বার্ধক্যের পথে যাত্রা করছি। এই যাত্রা কখন, কোন মুহূর্তে শেষ হবে—তা একমাত্র তিনিই জানেন, যিনি আমাকে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সেই মহেন্দ্রক্ষণ আমি নিজেও জানতে পারব না। একমাত্র জানবে আমার আপনজনেরা—তারা কাঁদবে, প্রিয়জনেরা শোক করবে—যেভাবে তারা আমার আগমনের দিনটিতে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল।
শুনেছি, আমার জন্মের শুভ দিনটি ছিল “ইস্টার সানডে”। চার ভাইয়ের পর এক মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই আনন্দ মাত্র পনেরো দিনের মধ্যেই দুঃখে রূপান্তরিত হয়। আমি জন্মগ্রহণ করি ১৯৬৪ সালে—সে বছর বসন্ত রোগের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ছিল। মানে মেডফোর্ড হাসপাতালে তখন বসন্ত রোগীর ছড়াছড়ি। আমিও পনেরো দিনের মাথায় আক্রান্ত হয়ে বাবা-মাকে চরম যন্ত্রণায় ফেলেছিলাম। এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সার্বক্ষণিক আমাকে দেখাশোনা করতেন বলেই আমার কোনো অঙ্গহানি হয়নি, এমনকি বসন্তের দাগও তেমন ছিল না। তার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল বলেই আজও বেঁচে আছি।
জীবনের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে এখন যখন বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন বাবার একটি কথা বারবার মনে পড়ে। বাবা বলতেন—আমরা যদি আমাদের বিশেষ দিনগুলো উদযাপনের জন্য পরিকল্পনা করে উৎসব পালন করতে পারি, তবে অসম্ভাবী কোনো “হঠাৎ” চলে যাওয়ার পর চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার জায়গা নিয়েও কেন প্রস্তুতি নেব না? বিশেষ করে আমি বর্তমানে যে দেশে আছি—উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্কে—যেখানে মরলে যন্ত্রণা কমে না, বরং বাড়ে। লোকে বলে, এই দেশে মরেও শান্তি নেই। কারণ এখানে কবর দিতে প্রচুর খরচ—কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার ডলার। সামর্থ না থাকলে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হয়। আবার সবকিছু নির্ভর করে এলাকা বা কবরস্থানের লোকেশনের ওপর।
এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। আমি এমন একজন মানুষ, যিনি সারাজীবন নিজের পরিবারের পরিমণ্ডলে—বাবার বাড়ি বা শ্বশুরবাড়িতে—প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়েছি। অথচ সেই আমাকেই ঈশ্বর আমেরিকার মতো একটি দেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করে এখানে ভালো চাকরি ও ভালো পজিশন পেয়েছি। সন্তানদের সুন্দরভাবে পড়াশোনা শেষ করে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পেরেছি। তার ওপর বিভিন্ন দেশে তীর্থযাত্রায় যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি।
এই তীর্থযাত্রার সূচনা হয়েছিল পুণ্যভূমি ইসরায়েল থেকে। এরপর একে একে ইতালি, রোম, পর্তুগাল, ফ্রান্স, স্পেন, ভারতের গোয়া এবং জার্মানির মতো দেশের অধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছি—যা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে এক বিশেষ আশীর্বাদ ও পরম প্রাপ্তি বলেই মনে করি। নিজেকে ভেবে আজও বিস্মিত হই। গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে জীবনে প্রথম প্রেম ও অবজ্ঞার অভিজ্ঞতাও পেয়েছি। অথচ সেই আমিই নিজের চেষ্টায় আমেরিকায় এসে নিজের বাড়ির সম্পূর্ণ লোন পরিশোধ করেছি, সন্তানদের ঘর বুঝিয়ে দিয়েছি এবং জীবনের সব ধরনের দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি। আজ কাঁধের ওপর কোনো ঝামেলার বোঝা নেই।
তবে এই দেশের স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা অনুযায়ী ৬৭ বছর পর্যন্ত কাজ করে যেতে হয়, তাই এখনো অফিসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও সম্পৃক্ত রয়েছি। প্রবাসী বেঙ্গলি খৃষ্টান এসোসিয়েশন ইউএসএ, ইনক.-এ বর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। যদিও এই পদটির চেয়েও আমার কাছে বড় দায়িত্ব হলো গির্জার গান পরিচালনা করা।
এই দায়িত্বটি পেয়েছিলাম অনেক ছোটবেলায়—যখন আমি সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি এবং লক্ষীবাজারে পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করতাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সিস্টার পলিন গোমেজ আমাকে শুধুমাত্র হারমোনিয়াম বাজাতে পারতাম বলেই এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—
“গির্জার গান মানুষকে শুনানোর জন্য নয়; বরং গানটি এমনভাবে লিড দিতে হবে যেন গির্জায় উপস্থিত সকলে সমসুরে অংশ নিতে পারে এবং গানের মাধ্যমে মানুষের মনে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি জাগ্রত হয়। এই পবিত্র দায়িত্ব মনে রেখেই গান পরিচালনা করবে।”
সেই কথাই আজও হৃদয়ে ধারণ করে প্রবাসের মাটিতে গির্জার গান পরিচালনা করে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি নিউইয়র্কের কুইন্সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জপমালা রানীর প্রেসিডিয়াম—সেনাসংঘের কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথেও সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছি।
এত কিছুর অবতারণার মূল কথাটি হলো—নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড এলাকায়, সেন্ট চার্লস কবরস্থানে “৬১” নম্বর কবর ক্রয়। সম্প্রতি প্রবাসী বেঙ্গলি খৃষ্টান এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বর্তমান সভাপতি মিস্টার গ্যাব্রিয়েল তাপস গোমেজ সেন্ট চার্লস কবরস্থানে নিউইয়র্কের স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ১০০টি কবর বুকিং দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ কবর ইতোমধ্যেই বাঙালি খৃষ্টানরা কিনে নিয়েছেন, আর বাকি কবরগুলোও বুকিংয়ের পথে।
আমিও প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে “৬১” নম্বর কবরটি কিনে ফেলেছি এবং হেডস্টোনের পরিকল্পনাও সম্পন্ন করেছি। আগে মনে হতো এটি ভয়ের বা কষ্টের বিষয়, কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুন—কবর কেনার পর থেকে এক অদ্ভুত পরম তৃপ্তি ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মনে হলো যীশুর সেই কথা—“সমস্তই সমাপ্ত হয়েছে।” যেখানে আমাকে শায়িত করা হবে, সেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সন্তানদের পাঠালাম—মনে হলো যেন এক বিরাট অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করলাম।
বাড়ি ফিরে এসে আবার ভাবনায় এলো—আমি তো একজন মানুষ, ঈশ্বরের সন্তান। একমাত্র পিতাই জানেন আমার মৃত্যু কিভাবে হবে এবং আদৌ আমি এই কবরে শায়িত হতে পারব কিনা। তাই নতুন করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালাম—সুস্থ ও সুন্দর জীবন নিয়ে যেন এই পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় নিতে পারি এবং ক্রয়কৃত “৬১” নম্বর কবরে অন্তিম নিদ্রায় নিদ্রিত হতে পারি।
এই কামনাকে হৃদয়ে ধারণ করেই আমার পড়ন্ত বেলায় প্রত্যাশার আরেকটি নতুন তীর্থযাত্রা শুরু হলো।
Chitra Rosario, New York, Jamaica