ধর্মের মূল শিক্ষা বনাম বিকৃত চর্চা: একটি মানবিক উদ্বেগ
ডা: আজিজ:
বেশিরভাগ ধর্মের মৌলিক শিক্ষা হলো সহানুভূতি, মানবতা এবং অন্যের প্রতি যত্ন ও দায়িত্ববোধ। অধিকাংশ ধর্মীয় মানুষ অন্যের কষ্টে আনন্দ পায় না; বরং তারা গভীরভাবে সহানুভূতিশীল, শান্তিপ্রিয় এবং সামাজিক কল্যাণ ও মানবিক মূল্যবোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে বাংলাদেশে আমরা কিছু ক্ষেত্রে এর বিপরীত বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছি। ইসলাম পরিচয়ধারী কিছু গোষ্ঠী এবং তাদের অনুসারীর মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক আত্মসমালোচনার ঘাটতি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ওসমান হাদির মৃত্যুর পর ছায়ানট, প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, নিউ নেশন, উদীচী, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। সাম্প্রতিককালে আমরা প্রকাশ্যে এক তরুণ অমুসলিম ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনাও দেখেছি, যার পর হত্যাকারীরা নিজেদের ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে উদযাপন করেছে। এসব ঘটনায় অংশগ্রহণকারীদের আচরণ ছিল আনন্দিত, উল্লসিত এবং উদ্বেগজনকভাবে বিকৃত—যেন তারা ইসলাম ধর্মের পক্ষে কোনো পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে বলে বিশ্বাস করছিল।
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও অনানুষ্ঠানিক অনুসন্ধান—বন্ধু, আত্মীয় এবং সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে—দেখায় যে অনেকেই নীরবে বা পরোক্ষভাবে এই ধরনের নির্মম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন বা যৌক্তিকতা প্রদান করছে। এটি মানবতা, মানবাধিকার এবং ধর্মের নৈতিক ভিত্তির জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে: ধর্মের নামে কেন এ ধরনের নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ সংঘটিত হয়?
মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গভীর সংকটের প্রতিফলন। শক্তিশালী গোষ্ঠীগত পরিচয়বোধ মানুষকে বহিরাগতদের অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখতে প্ররোচিত করতে পারে, নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি তৈরি করতে পারে এবং অন্যের কষ্টকে যুক্তিসংগত বা ন্যায়সঙ্গত বলে বিবেচনা করতে শেখায়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত ক্ষতি প্রাপ্য বা এমনকি ঈশ্বরপ্রদত্ত অনুমোদিত।
এছাড়াও, অনেক মানুষ বিশ্বাস ও পরিচয়ের সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছে। দয়া, বিনয়, করুণা ও ন্যায়বিচারের মতো ধর্মের মূল মূল্যবোধে গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে কেউ কেউ অন্যের কষ্ট বা অসম্মানে মানসিক শান্তি ও স্বীকৃতি খোঁজে। বহিরাগতদের দুর্দশা তাদের কাছে “আমরাই সঠিক” এমন ধারণায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে , যা একটি বর্জনমূলক মানসিকতা।
ধর্মীয় শিক্ষার ভুল ব্যাখ্যা এবং বাছাইকৃত পাঠ এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে তোলে। কেউ কেউ সহানুভূতি ও মানবিকতার শিক্ষাকে উপেক্ষা করে ধর্মকে শত্রুতা ও সহিংসতা বৈধ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে ধর্ম নৈতিক আচরণের দিকনির্দেশক না হয়ে ব্যক্তিগত পক্ষপাত, ক্ষোভ ও অসন্তোষ আড়াল করার একটি ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব দ্বারা পুষ্ট নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ববোধ মানুষের মনোভাব, আচরণ এবং সামাজিক মানদণ্ডকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। নিজেকে প্রশ্নাতীতভাবে সঠিক মনে করা সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে এবং আত্মসমালোচনার সুযোগ সংকুচিত করে। যখন মানুষ বিশ্বাস করে যে তারা ঈশ্বরের দ্বারা সুরক্ষিত বা সর্বদা সঠিক, তখন জবাবদিহিতা ও সহানুভূতি ক্রমশ লুপ্ত হতে থাকে।
আমি আশা করি দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সামাজিক নেতা, ধর্মীয় পণ্ডিত, সমাজবিজ্ঞানী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে এ ধরনের প্রবণতা বৈশ্বিক শান্তি, সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
পরিশেষে, আমি সকলকে অনুরোধ করছি উপরে আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য। সম্মিলিত দায়িত্ববোধ, নৈতিক আত্মসমালোচনা এবং অভিন্ন মানবিক মূল্যবোধের প্রতি নতুন করে অঙ্গীকারের মাধ্যমেই আমরা মানবতা ও আমাদের দেশের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি। অন্যথায়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
ধন্যবাদ।
কলামিস্ট ও ডা : আজিজ
লং আইল্যান্ড ।

















