বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ১০
ডা : আজিজ:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় জামায়াতে ইসলামি ও মুসলিম লীগের ভূমিকা: আজকের জন্য একটি সতর্কবার্তা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, সেগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামি ও মুসলিম লীগ ছিল সবচেয়ে সক্রিয়। এই দলগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সহায়ক বাহিনী গঠন করে, যারা মুক্তিকামী আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামি একীভূত পাকিস্তানের ধারণাকে সমর্থন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জামায়াতে ইসলামি আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে সমর্থন করত এবং মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখত। জামায়াতের সদস্যরা রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামসের মতো পাকিস্তানপন্থী সহযোগী বাহিনী গঠনে ও পরিচালনায় সরাসরি জড়িত ছিল। এই কুখ্যাত বাহিনীগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধ দমনে অংশ নেয়।
এই বাহিনীগুলো মুক্তিকামী মানুষদের সনাক্ত করা, গ্রামে গ্রামে অভিযান চালানো, সন্দেহভাজন মুক্তিযোদ্ধা বা সমর্থকদের গ্রেফতার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, দমন–পীড়ন ও প্রতিরোধ আন্দোলন ভাঙার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। তারা গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধেও অংশ নেয়। বিশেষ করে আল–বদর বাহিনী, যা জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে নৃশংস ভূমিকা পালন করে।
জামায়াতে ইসলামি রাজনৈতিক প্রচার ও প্রোপাগান্ডাতেও সক্রিয় ছিল। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার চেষ্টা করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা ইসলাম–বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে। দলটির শীর্ষ নেতারা সামরিক প্রশাসনের ডাকা বৈঠকে অংশ নিত, পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জোগাতে স্থানীয় নেটওয়ার্ক সক্রিয় করত এবং একীভূত পাকিস্তানের ইসলামি ঐক্যের ধারণা প্রচার করত।
তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক কৌশল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। বাঙালি জনগণের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পতন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কিন্তু স্বাধীনতার বিরোধিতায় জামায়াতের ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
আজ, আমরা যখন বিজয় মাস উদযাপন করছি, তখন দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালির উচিত ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী যে ভূমিকা পালন করেছিল তা স্মরণ রাখা। দুঃখজনকভাবে, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ দলের প্রভাব আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শক্তিশালী ধর্মীয় পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে, কৌশলগত রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলে এবং প্রতিষ্ঠিত সামাজিক–রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তারা ধীরে ধীরে পুনরুত্থানের চেষ্টা করছে। তাদের অতীত ইতিহাস ও চলমান বিতর্ক সত্ত্বেও এ ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা দেশের জন্য উদ্বেগজনক।
দেশের স্থিতি, ঐক্য এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করতে আমাদের সজাগ ও সচেতন থাকা জরুরি। আসুন, এই বিজয় মাসে আমরা স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি—যে মূল্যবোধের জন্য আমাদের পূর্বসূরিরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
কলামিস্ট ও ডা : আজিজ লং আইল্যান্ড ।

















