কিছু মৃত্যু আলো পায়, কিছু হারিয়ে যায়—রাষ্ট্রীয় শোকের বৈষম্য ও মর্যাদার বিপর্যয়
নয়ন বিশ্বাস রকি:
সাম্প্রতিক সময়ে ওসমান হাদীকে ঘিরে রাষ্ট্র ও সমাজে যে চিত্রটি নির্মিত হচ্ছে, তা আর কোনো সাধারণ শোক বা ব্যক্তিগত বেদনার সীমায় আবদ্ধ নেই। এটি ক্রমেই একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক বয়ান ও প্রতীকী কাল্ট নির্মাণের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে শোক ব্যক্তিগত নয়, বরং নির্বাচিত; স্মরণ সর্বজনীন নয়, বরং ক্ষমতানির্ভর। এই নির্বাচিত শোকের আলোয় বহু মৃত্যু ও ট্র্যাজেডি রাষ্ট্রীয় স্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে, যেন তারা রাষ্ট্রের কাছে স্মরণযোগ্যই নয়।
এই বৈষম্যের চিত্র সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় ভয়াবহভাবে স্পষ্ট। একজন বিএনপি নেতার বাসভবনে তালা দিয়ে নারী ও শিশুসহ মানুষ পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ উঠলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান কোনো শোক, নিরপেক্ষ তদন্তের অগ্রগতি কিংবা নৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দীপু চন্দ্র দাসকে পাওনা টাকা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে গাছে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়—এটি ছিল প্রকাশ্য জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার নির্মম দৃষ্টান্ত। অথচ এই বর্বরতার বিপরীতে কোনো জাতীয় শোক বা রাষ্ট্রীয় আত্মসমালোচনা আমরা দেখিনি।
একই সময়ে প্রয়াত হন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কৌশলী সামরিক সংগঠক, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। প্রশ্ন থেকেই যায়—তার রাষ্ট্রীয় জানাজা কোথায়, গার্ড অব অনার কোথায়, জাতীয় পতাকায় মরদেহ আচ্ছাদনের মর্যাদা কোথায়? এই নীরবতা কোনো দুর্ঘটনা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের রাজনৈতিক প্রতিফলন।
রাষ্ট্র যখন কিছু মৃত্যুকে আলোকিত করে আর কিছু মৃত্যুকে নীরবে চাপা দেয়, তখন অনিবার্যভাবে প্রশ্ন উঠে—রাষ্ট্রীয় শোক কি নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত, নাকি ক্ষমতার প্রয়োজন অনুযায়ী বাছাই করা? এই নীরবতার রাজনীতি আরও প্রকট হয়ে ওঠে সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিহত বাংলাদেশ সেনাসদস্যদের ঘটনায়। তারা কেবল সেনা নন, তারা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি, লাল-সবুজের পতাকাবাহক। অথচ তাদের মরদেহ দেশে ফেরানো, সম্মাননা ও রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলের ক্ষেত্রে যে অস্পষ্টতা ও অনীহা দেখা গেছে, তা বহু নাগরিকের বিশ্বাসকে আহত করেছে। রাষ্ট্র যেভাবে তার বীরদের গ্রহণ করে, সেভাবেই নাগরিকের আস্থা গড়ে ওঠে অথবা ভেঙে যায়।
এর বিপরীতে, একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক-সামাজিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় আবেগ, আনুষ্ঠানিকতা ও প্রতীকের উচ্ছ্বাস গভীর প্রশ্ন তোলে—এখানে ব্যক্তি নয়, নীতি কোন দিকে ঝুঁকছে? হাদীর নামে তথাকথিত ‘কালচারাল সেন্টার’ করার উচ্ছ্বাসে ছায়ানট ভাঙচুর হয়, সংবাদমাধ্যমের ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক লুট হয়, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীতে হামলা চালানো হয়। এসব ঘটনার ভেতরে যে মানসিকতা কাজ করছে, তা সংস্কৃতি নয়; এটি আধুনিক ফ্যাসিজমের প্রকাশ। এদের লক্ষ্য গড়া নয়, ভাঙা; মত তৈরি নয়, ভয় প্রতিষ্ঠা।
যে জনতা আজ হাদীর নামে মাতম করছে এবং বিদ্রোহী কবিতার উদ্ধৃতি ছড়াচ্ছে, ইতিহাস জানে—নজরুল বেঁচে থাকলে এই জনতার হাতেই তিনিই প্রথম অভিযুক্ত হতেন। কারণ নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরশ ছেদ করে উঠতে চেয়েছিলেন। এই সাহস সহ্য করার মতো গণতান্ত্রিক উদারতা এই বয়ানে অনুপস্থিত।
সবচেয়ে করুণ সত্য হলো—আজ যারা হাদীকে কবর দিলো, তারা আসলে জুলাই আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিকেই সমাধিস্থ করলো। একটি লাশকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় আলোচনার সব আলো কেড়ে নিয়ে বাকিদের অদৃশ্য করে দেওয়া হলো। আর যেটি সবচেয়ে কম আলোচিত, সেটিই সবচেয়ে ভয়ংকর—বাংলাদেশ আজ গভীর কাঠামোগত সংকটে নিমজ্জিত। এটি কেবল সরকার পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়; এটি রাষ্ট্রীয় নীতি, নৈতিকতা ও স্মৃতির সংকট।
ইতিহাস বলে, এই ধরনের সংকট চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু তা কাটে কেবল তখনই, যখন রাষ্ট্র সত্যকে স্বীকার করে এবং শোক, সম্মান ও মর্যাদাকে আবেগ ও ক্ষমতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়।
নয়ন বিশ্বাস রকি, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

















