Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৪

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৪

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৪

ডা: আজিজ:
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র — একটি জাতির স্বাধীনতার স্বর
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিধ্বনি—যা স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল এবং সমগ্র বাংলাদেশকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
২৬ মার্চ ১৯৭১, অপারেশন সার্চলাইটের বর্বর হামলার পরদিন, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রচারিত হয়, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান পাঠ করেন। ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমা হামলায় স্টেশনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিষ্ঠাতারা ত্রিপুরায় এবং পরে আগরতলায় স্থানান্তরিত হন।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন,
১. বেলাল মুহাম্মদ
২. সৈয়দ আব্দুস শাকের
৩. মুস্তফা আনোয়ারা হোসেন খান
৪. কাজী হাবিব উদ্দিন আহমেদ
৫. আবুল কাসেম সন্দ্বীপ
৬. মো. আমিনুর রহমান
৭. আব্দুল্লাহ আল-ফারুক
৮. এ. এম. শরফুজ্জামান
৯. মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী
10. রাশেদুল হোসেন 
তারা নিশ্চিত করেছিলেন যে এই বেতার কেন্দ্রটি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে—যেখানে দেশপ্রেমিক গান, ভাষণ এবং সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মনোবল উজ্জীবিত করা হয়।
চরমপত্র ছিল অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, যা উপস্থাপনা করতেন এম. আর. আখতার মুকুল। তিনি হাস্যরসাত্মক কণ্ঠে ও পুরনো ঢাকার ভাষায় পাকিস্তানি সেনাদের দুঃসময়ের বিবরণ দিতেন। আরেক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জল্লাদের দরবার, চালাতেন জনপ্রিয় অভিনেতা রাজু আহম্মেদ ও কল্যাণ মিত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে বিদ্রূপ করে “কেল্লা ফতে খান” নামে উল্লেখ করা হতো। বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানে প্রচারিত হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। তরুণ শিল্পীদের একটি দল অনুপ্রেরণাদায়ক গান পরিবেশন করতেন, এবং অনেক নতুন কবিতা ও গান লিখে বিশেষভাবে প্রচার করা হতো। এর মধ্যে জয় বাংলা, বাংলার জয় ছিল বেতারের স্বাক্ষর সুর।
গোবিন্দ হালদারের পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, এবং  সালাম সালাম হাজার সালাম—এসব গানও বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বেতারের শিল্পীরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহ করতেন। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় সংবাদ প্রচার করা হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কামাল লোহানী স্মরণ করে বলেন, “আমাদের কাছে এটি ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—আমরা এমন কথা বলতাম যা মানুষের মনোবল দৃঢ় করত।”
বেতারের বিশিষ্ট কর্মীদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরি, কামাল লোহানী, এম. আর. আখতার মুকুল, আলী যাকের, বাবুল আখতার, আশরাফুন আলম,আশফাকুর রহমান খান,আব্দুল জব্বার খান, সমর দাস, অজিত রায়, সুজেয় শ্যাম, আপেল মাহমুদ, অমিতাভ সেনগুপ্ত, মঞ্জুলা দাসগুপ্ত, আব্দুল জব্বার, মালা খান, রূপা খান, রফিকুল আলম, কাদেরী কিবরিয়া, লাকি আখন্দ, জাহাঙ্গীর হায়াত খান, মোহাম্মদ শাহ, নাসিমুল কাদের চৌধুরী, জাহিদ সিদ্দিকী, মিহির কুমার নন্দী, শেখ ফয়সাল ইসলাম, সুভাষ দত্ত, তিমির নন্দী, ফকির আলমগীর, সুমিতা দেবী, দালিয়া নওশীন এবং বুলবুল মহালনবিশ।
স্বাধীনতার পরে, এই বেতার কেন্দ্রটি বাংলাদেশের জাতীয় বেতার সেবা বাংলাদেশ বেতার-এ রূপান্তরিত হয়।
সবশেষে বলা যায়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে—এটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে এবং সংগ্রামের সাহস যুগিয়েছে। এই মহান প্রতিষ্ঠানের অবদানে আমি গর্বিত, এবং এর সকল সদস্যের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও অশেষ সম্মান জানাই।
কলামিস্ট ও ডা : আজিজ, লং আইল্যান্ড ।