Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৯

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৯

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৯

ডা : আজিজ:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বন্ধু, ১৯৭১

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহু বিদেশি ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা—এই সত্যিকারের বন্ধুরা —সরাসরি ও পরোক্ষভাবে সাহায্য, সমর্থন, প্রভাব এবং সহযোগিতা করেছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমি তাঁদের নাম ও অবদান উল্লেখ করছি।
ইন্দিরা গান্ধী:
যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যস্ত মানুষের প্রতি পূর্ণ সরকারি সহায়তা প্রদান করেন। তাঁর সরকার পূর্ব সীমান্ত খুলে দেয়, ফলে এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়। ভারত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করে এবং পরবর্তীতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শুরু থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সীমান্ত পোস্টে যৌথ আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বজুড়ে সমর্থন জোগাড়ের জন্য ভ্রমণ করেন এবং বিশ্বনেতাদের পাকিস্তানের বর্বরতা থামাতে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক ফারজ রাফায়েল জ্যাকব:
১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন, শরণার্থী শিবির পুনর্গঠন, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য, যা বাংলাদেশের বিজয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
উইলিয়াম এ. এস. আউডারল্যান্ড:
ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান এবং বাটা সু কোম্পানির উৎপাদন ব্যবস্থাপক আউডারল্যান্ড সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সাবেক সৈনিক হিসেবে তিনি গোপনে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং টঙ্গীর বিভিন্ন গোপন ক্যাম্পে, এমনকি বাটা কারখানার ভেতরেও, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর বীরোচিত অবদান তাঁকে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে স্মরণীয় করে রেখেছে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস:
পাকিস্তানি সাংবাদিক মাসকারেনহাস পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ অমান্য করে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব সত্য বিশ্বকে জানান। প্রচার চালানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে পাঠানো হলেও তিনি ১৯৭১ সালের ১৩ জুন লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস-এ “Genocide” শিরোনামে ১৬-কলামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সাইমন ড্রিং:
বর্বর 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরুর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় ২০০ বিদেশি সাংবাদিককে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটকে রেখেছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে সাইমন ড্রিং পালিয়ে গণহত্যার সাক্ষী হন এবং তা বিশ্বকে জানান।
স্যার উইলিয়াম মার্ক টালির:
১৯৭১ সালে বিবিসির ভারত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর রেডিও প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পেত, বিশেষ করে যখন পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম মিথ্যা প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল।
জর্জ আন্দ্রে মালরো:
ফরাসি ঔপন্যাসিক, প্রতিরোধ আন্দোলন সদস্য ও ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী মালরো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জনে ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে তাঁর সফরকালে তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেন।
এডওয়ার্ড কেনেডি:
মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতীয় শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানান, মানবিক সহায়তা প্রত্যাশা করেন এবং ওয়াশিংটনকে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান।
পল ও এলেন কনেট:
এই বিদেশি দম্পতি গণহত্যার বিরুদ্ধে সরব হয়ে আন্তর্জাতিক মতামত গড়তে সাহায্য করেন। তারা প্রতিবাদ আয়োজন করেন এবং পশ্চিমা বিশ্বে পাকিস্তানের নৃশংসতার তথ্য পৌঁছে দেন।
জর্জ হ্যারিসন ও রবি শঙ্কর:
এই কিংবদন্তি শিল্পীরা নিউ ইয়র্কে ঐতিহাসিক “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” আয়োজন করেন, যার মাধ্যমে শরণার্থীদের জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার তোলা হয় এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
জ্যাঁ ইউজিন পল কে, ২৯ বছর বয়সী একজন ফরাসি মানবিক কর্মী, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করেন এবং দাবি জানান যে ২০ টন চিকিৎসা সামগ্রী বিমানে তোলা হোক এবং সেগুলো ভারতের আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের কাছে পাঠানো হোক।
অক্সফাম ও ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস:
এই দুটি সংস্থা মানবিক সহায়তা প্রদান এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন:
সোভিয়েত ইউনিয়ন কূটনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা প্রদান করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘে সোভিয়েত ভেটো, ভারত মহাসাগরে নৌ মোতায়েন, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন সহযোগিতা—সবই বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
শেষে, আমি সকল ব্যক্তি, সংস্থা ও সরকারকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা আমাদের সাহায্য, সমর্থন ও উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের সংহতি আমাদের সাহস ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ অর্জন করতে পেরেছি।
কলামিস্ট ও ডা: আজিজ, লং আইল্যান্ড ।