Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৬

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৬

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৬

ডা. আজিজ:

১৯৭১-এর সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদের স্যালুট 

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ ছিল না—এটি ছিল এক গভীর সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক সংগ্রাম। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী সংগঠনগুলো জাতীয় পরিচয় গঠন, জনগণকে সংগঠিত করা এবং স্বাধীনতার লড়াইকে উদ্দীপ্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর প্রভাব ফেলেছিল, সেগুলোর মধ্যে ছিলেন শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ এবং ছাত্রনেতৃত্বাধীন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, যারা গান, সাহিত্য, নাটক ও শিল্পের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১.ছায়ানট 
২.উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
৩.বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা
৪.স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
৫.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো
৬.বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সংস্থা
এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামের স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন, এবং বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শিল্পকে বিপ্লবের অস্ত্রে রূপান্তরিত করে প্রমাণ করে যে মুক্তিযুদ্ধ কেবল সামরিক সংগ্রাম ছিল না, বরং ছিল গভীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অসাধারণ অবদান ছিল—
* পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
* দেশাত্মবোধক গান, নাটক ও কবিতা পরিবেশন করে সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা।
* বহু তরুণ শিল্পী ও কর্মীকে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করতে অনুপ্রাণিত করা এবং অন্যরা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মাধ্যমে জনমনে সাহস জুগিয়েছিলেন।
* বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রসংগীত এবং লোকসংস্কৃতি প্রচারের মাধ্যমে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ও বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করা।
* শরণার্থী শিবির ও মুক্তাঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে ঐক্য ও মনোবল শক্তিশালী করা।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর— বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে—পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের হাতে এক হাজারেরও বেশি বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ, নির্যাতন ও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটি ছিল নবজাত বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। তাঁদের এই আত্মত্যাগই আজ স্বাধীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাঁদের স্মরণ করা হয়।
স্বাধীনতার পরে ছায়ানট ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি লালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আজ তারা শুধু শিল্প-সংস্কৃতির কর্মযজ্ঞেই নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক হিসেবেও স্বীকৃত।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় মাসে আমি গভীর সম্মান, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাই সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং তাদের সদস্যদের প্রতি—তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা, ত্যাগ, উদারতা এবং দেশপ্রেমের জন্য। তাদের সমর্থন ছাড়া ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হয়তো আরও দীর্ঘ হতো। বাংলাদেশের মানুষ কখনো ভুলবে না তাদের ত্যাগ এবং স্বাধীনতার জন্য অসামান্য অবদান।

আজিজ,লং আইল‍্যান্ড