Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৫

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৫

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য—পর্ব ৫

ডা. আজিজ, লং আইল্যান্ড:

ক্র্যাক প্লাটুনের উত্তরাধিকার: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নায়করা

ক্র্যাক প্লাটুন ছিল মুক্তি বাহিনীর একটি কিংবদন্তি এবং বিশেষ কমান্ডো ইউনিট, যা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে সাহসী অভিযান পরিচালনা করার জন্য গঠন করা হয়েছিল। এই ইউনিটটি গঠন করেন বিশিষ্ট সামরিক নেতা ব্রিগেড কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালানোর জন্য বিশেষ বাহিনীর প্রয়োজন। তার চিন্তাশক্তি এবং দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি দেশব্যাপী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে এবং স্বাধীনতার জন্য সাহসিকতার অবদান রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।খালেদ মোশাররফ, সেক্টর কমান্ডার মোহাম্মদ হায়দারের সঙ্গে মিলে, বিভিন্ন মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে সেরা তরুণ গেরিলা যোদ্ধাদের বাছাই করে নিয়েছিলেন। এই যোদ্ধারা শুধু প্রশিক্ষিত ছিলেন না, বরং ঢাকা শহরের সঙ্গে তাদের গভীর পরিচিতি ছিল এবং স্বাধীনতার প্রতি তাদের অটল নিষ্ঠা ও আগ্রহ ছিল। ১৯৭১ সালের জুন মাসে, তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় ক্র্যাক প্লাটুন গঠন করা হয়, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র এবং তরুণ নাগরিকরা ছিল। তারা ছিলেন দেশমাতৃকার প্রতি সবচেয়ে নিষ্ঠাবান ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা।

ডা. আজিজ

ক্র্যাক প্লাটুনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঢাকা শহরের নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা এবং সারা পৃথিবীকে দেখানো যে, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি পাকিস্তানি সরকারের দাবির মতো স্বাভাবিক নয়। তারা সাহসী কমান্ডো স্টাইলের আক্রমণ পরিচালনা করে সেনা ঘাঁটি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যোগাযোগ কেন্দ্র এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিতে। এই গেরিলা আক্রমণগুলো ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এবং মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধ শক্তি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল।
ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা ছিল মুক্তি বাহিনীর সফলতার জন্য অপরিসীম। তাদের সাহসিকতা এবং কৌশলগত দক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তাদের সাহসিকতার জন্য ছয়জন ক্র্যাক প্লাটুন কমান্ডোকে বীর বিক্রম, বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গৌরব পদক প্রদান করা হয়, এবং আরও দুইজনকে বীর প্রতীকউপাধি দেওয়া হয়।
তবে, তাদের সাহসিকতার জন্য ক্র্যাক প্লাটুনও একটি মূল্য চুকাতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট একটি অশুভ দিনে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কয়েকজন ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য এবং প্রসিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা, যেমন: শফি ইমাম রুমি, মগফর আহমেদ চৌধুরী আজাদ, বদিউল আলম, জাতীয় ক্রিকেট খেলোয়াড় জুয়েল, এবং মোহাম্মদ আবু বকরকে ধরে ফেলে এবং মেরে ফেলে। এই মহান মুক্তিযোদ্ধারা শাহাদাৎ বরণ করেন, কিন্তু তাদের আত্মত্যাগ দেশের স্বাধীনতার প্রতি চিরকালীন প্রতিশ্রুতির প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা শুধুমাত্র সাহসী সেনা নন, বরং তারা ছিলেন প্রতিভাবান এবং উজ্জ্বল ব্যক্তি, যাদের দেশপ্রেম এবং আত্মনিবেদিত সেবা দেশের জন্য ছিল অতুলনীয়। আজ, বিজয়ের মাসে, আমরা তাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাদের দৃঢ়তা, নিষ্ঠা এবং প্রতিশ্রুতি আগামী প্রজন্মকে চিরকাল প্রেরণা দেবে। ক্র্যাক প্লাটুন এবং সব মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ কখনো ভুলে যাওয়ার নয়, এবং তাদের অবদান চিরকাল বাংলাদেশের হৃদয়ে অম্লান থাকবে।

আজিজ, লং আইল্যান্ড