গল্প: জামতলা—সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী
প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:
শীতের রাত।চারদিক নিঝুম।বাইরে ভীষণ কুয়াশা।চয়ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনছে।তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ।মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনের খবর শুনছে আগ্রহ সহকারে।চয়ন খবর শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আজ মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েক জায়গায় পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে বীরত্বের সঙ্গে দখল করেছে ঘাঁটিগুলো।পিঠে হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।সায়মা দাঁড়িয়ে আছে।ভাত খেয়ে নাও,ঠান্ডা হয়ে যাবে।মাটিতে মাদুর বিছিয়ে দু'জনে একসঙ্গে খেতে বসে। চয়ন বিয়ে করেছে মাত্র তিন মাস হলো।সায়মা খুব সেবা যত্ন করে তার।দু'জনে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যায় বিছানায়।সায়মা চয়নকে জড়িয়ে ধরে বলে,কদিন থেকে আমার ভয় করছে। চয়ন সায়মাকে বুকের কাছে টেনে নেয়।কীসের ভয়,আমি তো কাছে আছি।চুমু খায় লজ্জারাঙা ঠোঁটে।সায়মা চোখ বুঁজে পরম সুখে।বেশ কিছু সময় দু'জন ভালোবাসার সাগরে হাবুডুবু খায়।সায়মা চয়নকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
ভোরে পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে সায়মার।বিছানা ছেড়ে উঠে বসে।চয়নকে ডাকে।চয়ন খুব জোরে হাই তোলে।বিছানা ছেড়ে বাথরুমে যায়।হাত মুখ ধুয়ে দু'জনে একসঙ্গে চা-নাশতা করে।এমন সময় চয়নের বন্ধু সুজন আসে।চোখে মুখে বিষাদের ছাপ।চয়ন বললো,কিরে,কী হয়েছে,তোর মুখ এত মলিন কেন?সুজন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।চয়ন বলে,বলবে তো কী হয়েছে? সুজন বলতে গেলে ঠোঁট কাঁপতে থাকে।চয়ন অনেক বুঝিয়ে শান্ত করার পর বলে,পাক হানাদার বাহিনী রাতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তার মা-বাবা-ভাই-বোন সবাইকে গুলি করে মেরেছে।তারপর আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে।সে তখন বাহিরের বাথরুমে ছিলো।সেখান থেকে ঝোঁপ জঙ্গলে লুকিয়ে সব দেখেছে নিজ চোখে।পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে পাড়ার মুনশি আসগরও ছিলো ।তার মুখ চাঁদনি রাতের চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল। চয়নের বুকে যেন সাগরের পাড় ভাঙার শব্দ হয়।নিজেকে সামলিয়ে বন্ধু সুজনকে বুকে জড়িয়ে সাহস দেয়।ভয় নেই আমারা দুই ভাই আছি।নিজ হাতে সুজনের চোখের জল মুছে দেয় চয়ন।সায়মা চা নাশতা নিয়ে আসে।সুজন খেতে চায় না।চয়নের অনুরোধে শেষে একটু নাশতা মুখে দেয়।দুই বন্ধু একসঙ্গে বের হয়ে যায়।
দুপুরের ফর্সা আলোয় চারদিক ঝলমল।সায়মা জানালার পাশে চয়নের আসার পথের দিকে চেয়ে আছে।চয়ন বন্ধু সুজনকে নিয়ে ঘরে ফিরে।সায়মাকে বলে পাড়ায় থাকা উচিত হবে না।তাড়াতাড়ি কাপড় চোপড় ঠিক করে তৈরি হও।আমরা এখনই পাড়া ছেড়ে চলে যাব।সায়মা স্বামীর কথার অবাধ্য না হয়ে গুছিয়ে নেয় ঝটপট।ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়।তারা হাঁটতে শুরু করে।পাড়ার পরিচিত একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিয়ে রওয়ানা হয় জামতলা গ্রামে।বিকেলের দিকে জামতলা পৌঁছে যায়।চয়নের মামার বাড়ি।গাড়ির হর্ণ শুনে মামাতো ভাই বোন দৌড়ে বের হয়।মামা মামি ও বের হন।চয়ন গাড়ি থেকে নেমে মামা মামিকে কুশলাদি জিগ্যেস করে।মামি সায়মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।ঘরে নিয়ে যান তাদের।শহরের অবস্হা জানতে চান।উৎকন্ঠা চোখে মুখে।চয়ন মামার কাছে শহরের অবস্হার বর্ণনা দেয়।পাড়ায় পাড়ায় পাক হানাদার বাহিনী ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে।ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারছে নিরপরাধ লোকজনকে।লাইন করে হাত পা বেঁধে গুলি করে মারছে।গাড়িতে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে বহুদূরে বন্দি করে রাখছে।পরে হত্যা করছে লোকজনকে।চয়নের কথাগুলো শুনে মামার চোখে জল ঝর ঝর করতে থাকে।চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছেন তিনি।চয়ন সুজনকে পরিচয় করিয়ে দেয়।এর বাবা- মা -ভাই- বোনকে পুড়িয়ে মেরেছে পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা ।পাড়ার মুনশি আসগর ছিল এ হত্যাকান্ডের মূল নায়ক।চয়নের মামা বলেন পাড়া মহাল্লা গাঁয়ে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
মধ্যরাত।জামতলা গ্রামের লোকজন গভীর ঘুমে মগ্ন।চয়ন মামা মামীকে সালাম করে বিদায় নেয় মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে।সঙ্গে বন্ধু সুজন ও।সায়মাকে মামা মামির কাছে রেখে যায়।মামা জামতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।একজন আর্দশ শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম আছে।তিনি চয়ন ও সুজনের মাথায় হাত দিয়ে সাহস দেন।সায়মার চোখের পাতায় শিশির বিন্দুর মতো জল।চয়ন আঙুল দিয়ে সায়মার চোখের জল মুছে দেয়।সায়মাকে সাহস দেয়,ভয় করো না সায়মা।মামা মামি আছেন।তোমার কোনও অযত্ন হবে না।আমার জন্য দোয়া করো।দেশ মাটিকে যেন মুক্ত করতে পারি।সায়মা মনকে শক্ত করে নেয়।বাহিরে উঠোনে দাঁড়িয়ে শীতের কনকনে রাতে বিদায় দেয় চয়নকে।চয়ন সুজনকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে থাকে।সায়মা দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে চয়নের চলার পথের দিকে।মামির ডাকে ঘুরে দাঁড়ায় সায়মা।ঘরের দিকে পা বাড়ায় চয়ন।রাতেই রওয়ানা দেয় সীমান্তের দিকে।পথে আরও অনেকে শরীক হয়।চয়ন ও সুজন অন্যদের নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করে ভারতে।সেখানে তারা খুঁজে বের করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।সেখানে গিয়ে নাম লেখায়।তারপর শুরু হয় ট্রেনিং।ট্রেনিং শেষে রণাঙ্গনে যায়।মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।গহীন বন জঙ্গলে আঁধারে মশার কামড়েও মনোবল হারায় না।অসীম সাহস নিয়ে যুদ্ধে লড়তে থাকে।এভাবে অনেক অপারেশনই সফল হয় চয়নদের দল।এমন কী এক রণাঙ্গনে একদিন রাতে শত্রুর মুখোমুখি হয়।শুরু
হয় গোলাগুলি।দু দিক
থেকেই গুলি ঝাঁকে ঝাঁকে চলতে থাকে।হঠাৎ একটি গুলি চয়নের বাম পায়ে লাগে।চয়ন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। চয়নের সাথীরা চয়নকে কোলে
তুলে নেয়।গুলি ছুঁড়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে।সুজন ও অন্যরা চয়নকে নিয়ে যায় পাশের হাসপাতালে।সেখানে চয়নের বাম পা কেটে ফেলা হয়।আস্তে আস্তে সুস্হ হয়ে ওঠে চয়ন।চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজ পতাকা।মুখে আনন্দের ফোয়ারা।পা হারাবার দুঃখ তাকে দুর্বল করতে পারেনি।সুজন এসে খবর দেয় দেশ স্বাধীন হয়েছে।
পরদিন সকালে হাসপাতাল ছেড়ে রওয়ানা হয় জামতলা গ্রামে।পথে পথে মিছিল।বিজয়ের গান।পতাকা উড়ছে পত পত।মানুষের মাঝে খুশির বান বইছে।গাড়ির জানালা দিয়ে দেখে চয়নের মন জুড়ে যায়।মানুষ আনন্দে বাড়িঘরে ফিরছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।চয়ন জামতলা গ্রামে পৌঁছে একসময়।মামার বাড়ির আঙিনায় গাড়ি থেকে নেমে দেখে বিধ্বস্ত বাড়ি।কোনও লোকজনের সাড়া নেই।চয়ন সায়মা খুঁজতে থাকে।মামা মামিকেও।বিধ্বস্ত ঘরে কেউ নেই।কালো মুখে চয়ন বসে যায় মাটিতে।পিঠে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে। চোখ তুলে দেখে মামার বন্ধু জামতলা গ্রামের ডাক্তার ফরমান আলী।তিনি চয়নকে ধরাধরি করে দাড় করান।বুকে জড়িয়ে ধরেন।চয়ন মামা মামি ও সায়মার কথা জানতে চায়।ফরমান আলীর কন্ঠ আড়ষ্ট হয়ে যায়।তিনি অনেক কষ্টে বলেন, এরা আর আসবে না কোনদিনও।পাক হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে তাদের।গুলি করে সারা বাড়ি ঝাঁঝরা করে যায় রাতের আঁধারে।পরদিন গ্রামের লোকজন বাড়ির পিছনে আম গাছের নিচে কবর দেয় তাদের।আর তিনি কথা বলতে পারলেন না,ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
চয়ন ছুটে যায় বাড়ির পিছনে আম গাছের নিচে।শোকে পাথর হয়ে যায়।নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।এখানে এসে সান্ত্বনা দেন ফরমান আলী।চয়ন বিধ্বস্ত ঘরেই বসবাস করতে থাকে।সায়মার স্মৃতিকে বুকে লালন করেই থেকে যায় জামতলা গ্রামে।সেখানে গড়ে তুলে সায়মা পাঠাগার।আর সেই পাঠাগারে বসে প্রতিদিন লিখতে থাকে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা চয়ন রণাঙ্গনের সেই বীরত্বগাঁথা---------।

















