শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন: গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় অগ্নিশিখার মতো এক নাম
ডা. আজিজ, লং আইল্যান্ড:
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে যে কজন অমর শহীদের নাম চিরস্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তাদের অন্যতম হলেন শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন। তিনি শুধু একজন চিকিৎসক নন—ছিলেন চিকিৎসক সমাজের নেতৃত্বদানকারী সাহসী কণ্ঠ, একজন সংগঠক, একজন প্রেরণাদাতা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের অগ্রসৈনিক।
শহীদ ডাঃ মিলন
১৯৫৭ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় জন্ম নেওয়া ডা. মিলন ছিলেন মেধা, নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের এক অনন্য সমন্বয়। নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। পরবর্তীতে বায়োকেমিস্ট্রিতে এম.ফিল সম্পন্ন করে যোগ দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। শিক্ষকতা, গবেষণা এবং চিকিৎসা—সবকিছুতেই তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
তবে ডা. মিলনের বৃহত্তর পরিচয় ছিল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)–এর যুগ্ম সচিব হিসেবে চিকিৎসক সমাজকে সংগঠিত করা এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া। এরশাদের একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ছাত্র, চিকিৎসক ও পেশাজীবীদের সংগঠনের অন্যতম চালিকাশক্তি। গণতন্ত্রের পক্ষে তার অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট, অপ্রতিরোধ্য এবং আপসহীন।
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর—বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্ধকারে লেখা এক দিন।
এই দিনে এরশাদের অনুগত সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে শহীদ হন ডা. মিলন। তার নিথর দেহ পুরো জাতিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে; হাজার হাজার মানুষ কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামে। চিকিৎসক, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিকসহ সকল পেশার মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তার রক্তে জেগে ওঠে জাতি—অব্যাহত ধর্মঘট, অবরোধ ও গণঅভ্যুত্থানে সরকার পঙ্গু হয়ে পড়ে।
ডা. মিলন হত্যার মাত্র নয় দিন পর,
৬ ডিসেম্বর ১৯৯০—এরশাদকে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
অর্থাৎ, ডা. মিলনের আত্মদান ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ঘটনা, যা গণতন্ত্রকে পথ দেখায় বীরোচিত উত্তরণ।
আজ তাই ডা. মিলন শুধু একজন শহীদ নন—তিনি গণজাগরণের প্রতীক,
সাহস ও নৈতিকতার অগ্নিশিখা,
স্বাধীনতা–গণতন্ত্রের পথপ্রদর্শক।
প্রতিবছর ২৭ নভেম্বর শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয় গভীর শ্রদ্ধায়। তার আদর্শ আজও ছাত্রসমাজ, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। তার ত্যাগ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়—গণতন্ত্র আসে না; অর্জন করতে হয়, রক্ষা করতে হয়, প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করতে হয়।
শেষে বলতে চাই—
বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো নানা চ্যালেঞ্জের মুখে।
ডা. মিলনের ত্যাগ ও দৃঢ়তা আমাদের পথ দেখাক।
তার অগ্নিমানব চরিত্র থেকে আমরা যেন নতুন প্রেরণা পাই একটি শক্তিশালী, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের সংগ্রামে।
আমি শহীদ ডা. মিলনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
কলামিস্ট ও ডা. আজিজ, লং আইল্যান্ড।

















