Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   বিজয়ের দিনে—সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী

বিজয়ের দিনে—সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী

বিজয়ের দিনে—সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী

প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:

সোনালি রোদের নরম ছোঁয়ায় শিশির-ঝলমলে ঘাসের ডগাগুলো ঝিকিমিকি করছে। শীতের কনকনে হাওয়া জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ার টেবিলে বসে থাকা কিশোর সুজনের গায়ে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। ঘরের মেঝেতে সোনালি আলো দুষ্টু বাচ্চার মতো লুটোপুটি খাচ্ছে।
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো ছন্দময় মিছিলের আওয়াজ। সুজন চমকে উঠে জানলার বাইরে তাকাতেই দেখল—একঝাঁক শিশু-কিশোর এগিয়ে আসছে। কারও হাতে বর্ণিল ফেস্টুন-ব্যানার, কারও হাতে রঙিন বেলুন, আবার কারও কাঁধে বাঁশের তৈরি প্রতীকী অস্ত্র। মিছিলের অগ্রভাগে একটি কিশোর—মাথায় লাল ফিতা, হাতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।
মাইকে বাজছে সেই চিরচেনা মুক্তিযুদ্ধের গান—
“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি…”
সুজনের হৃদয় অদ্ভুত এক আবেগে ভরে ওঠে। হঠাৎ মনে পড়ে—আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বই বন্ধ করে দ্রুত প্রস্তুতি নেয় সে। জীবনের বাসায় যায়, সেখান থেকে অন্য বন্ধুদের ডেকে নেয়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুজনও মিছিলে নামে। শ‍্যামল বাবুর বাড়ি থেকে ফুল নেয় তারা; শ‍্যামল বাবু হাসিমুখে স্নেহভরে ফুল তুলে দেন। জামানের বাসা থেকে আনা একটি পতাকা বাঁশে বেঁধে সুজন মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়ায়।
ছোট্ট দলটি মিছিল করতে করতে প্রথমে পৌঁছে যায় শহীদ মিনারে। মিনারজুড়ে স্তূপাকৃত ফুলের মধ্যে সুজনরা তাদের ফুল অর্পণ করে, তারপর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে শপথ নেয়—
বিজয়কে রক্ষা করব, মুক্তিকে অম্লান রাখব।
শহীদ মিনার থেকে তারা নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলে। শহরের অলিগলি মাতিয়ে তোলে দামাল কিশোরদের কণ্ঠঃ
“বিজয় এনেছি, বিজয় রাখব।”
মুক্তির গান, জয়গান, উল্লাস—সব মিলিয়ে এক অনন্য দৃশ্য।
মিছিল গিয়ে থামে পাড়ার স্কুলে। স্কুল প্রাঙ্গণ আজ উৎসবের সাজে সেজেছে—রঙিন কাগজের ঝালর, উঁচু বাঁশে উড়ন্ত পতাকা, মাঠজুড়ে আনন্দমেলা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে সবাই; শিক্ষক-শিক্ষিকারা অংশ নেন সমস্বরে। তারপর মিষ্টি বিতরণ, খেলাধুলা—পুরো স্কুল আনন্দে মুখর।
গত বছর বিজয় দিবসে সুজন বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এ বছর শরীরটা ভালো নয় বলে খেলা না করেও মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সবার আনন্দ দেখে তার মুখটা সোনালি চাঁদের মতো ঝলমল করে ওঠে। মনে হয়, খুশির অগণিত রঙিন বেলুন উড়ে যাচ্ছে আকাশে।
আজ মহান বিজয়ের দিন—আনন্দের দিন, উৎসবের দিন। বাংলার আকাশ আজ নীল, পাখিরা মুক্ত ডানায় উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঠে মাঠে পাকা ধানের সুবাস, ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি, কৃষাণ-কৃষাণির হাসি, রাখালের বাঁশির মিষ্টি সুর—সব মিলিয়ে এ যেন আবহমান গ্রামবাংলার সোনালি ছবির পুনর্জন্ম।
এই দিনের জন্যই তো বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরেছিল গর্বের স্লোগান নিয়ে—
“জয় বাংলা, জয় বিজয়।”
সুজন অজান্তেই গুনগুন করে—
“বিজয়ের মালা গলে পরে গর্বিনী মা হাসে…”
সবুজ-শ্যামল বাংলার গৌরব আজ তার চোখে দীপ্ত—রক্তিম সূর্যের আলোর মতো।
ঠিক তখনই পিঠে হাতের উষ্ণ স্পর্শ। ঘুরে দাঁড়াতেই জীবন।
—“কী রে, কী ভাবছিস? কবিতা লিখবি নাকি?”
হেসে ওঠে জীবন।
সুজনের চোখেমুখে যেন বিজয়ের সোনালি আলো।
—“না রে, কবি নই। তবে আজ খুব খুশি লাগছে। আজ তো বিজয়ের দিন!”
দু’জনের হাসিতে মিশে যায় চারদিকের আলো। বিজয়ের সূর্য যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কলামিস্ট ও কবি: সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী