Logo

আন্তর্জাতিক    >>   বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য পর্ব-১

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য পর্ব-১

বিজয়ের ডিসেম্বর: মুক্তির চেতনায় শ্রদ্ধার্ঘ্য পর্ব-১

ডা. আজিজ, লং আইল্যান্ড:

ডিসেম্বর—আমাদের ইতিহাসের পবিত্রতম মাস। এই মাসের প্রতিটি দিন জেগে ওঠে বিজয়ের আলোয়, স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭১-এর সেই মহত্তম লড়াই, যে লড়াই আমাদের জাতিকে দিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ, আত্মমর্যাদার পরিচয় এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; এটি ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির এক গৌরবময় বিদ্রোহ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর ক্ষমতার ভার ছিল অগণতান্ত্রিক বৈষম্য ও শোষণের কঠোর শৃঙ্খলে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে নতুন শক্তি দেয়। এই আন্দোলন কেবল ভাষা রক্ষার ছিল না—এটি ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও রাজনৈতিক চেতনার প্রথম বড় জাগরণ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অবমূল্যায়ন বাঙালি সংস্কৃতিকে পরিণত করে প্রতিরোধ, ঐক্য এবং আত্মমর্যাদার প্রতীকী শক্তিতে।


অর্থনৈতিক বৈষম্যের বোঝা ছিল আরও নির্মম। পাট রপ্তানির আয়ে রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হলেও তার সুফল যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, অবকাঠামো—সবকিছুর কেন্দ্রীকরণ ছিল করাচি ও লাহোরকে ঘিরে। রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে বাঙালিদের সুযোগ ছিল সীমিত। উচ্চশিক্ষিত তরুণদেরও চাকরিতে বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হতো, যা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তীব্র করে তোলে।
এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা আওয়ামী লীগের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট পাওয়ার পরও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চালায় অপারেশন সার্চলাইট—একের পর এক নৃশংস গণহত্যা, যেখানে ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, পুলিশ, গ্রাম-শহরের নিরীহ মানুষ কেউ রক্ষা পায়নি। সেই রাতেই বাঙালি জাতি সিদ্ধান্ত নেয়—স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধই পথ। স্বাধীনতার ঘোষণার পর সংগঠিত হয় মুক্তিবাহিনী এবং শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।
আজ আমরা স্মরণ করি কেন এবং কীভাবে আমরা এই স্বাধীনতার মর্যাদা অর্জন করেছি। আমাদের স্বাধীনতা কেবল একটি ভূ-রাজনৈতিক সীমানা নয়; এটি আত্মপরিচয়, অধিকার, মর্যাদা এবং স্বপ্নের জন্ম। এই স্বাধীনতা এসেছে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে—তাই এর মূল্য অপরিসীম।
আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই সকল শহীদ, তাঁদের পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, শ্রমজীবী মানুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী, সশস্ত্র বাহিনী এবং যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। বিশেষ শ্রদ্ধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম. এ. জি. ওসমানী এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি—যাঁদের নেতৃত্ব, ত্যাগ ও দৃঢ়তা আমাদের স্বাধীনতার পথ নির্মাণ করেছে।
বিজয়ের এই মাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তাকে রক্ষা করা বড় দায়িত্ব। এই চেতনা ও অঙ্গীকারই আমাদের পথচলার প্রেরণা হয়ে থাকবে।
কলামিস্ট , ডা: আজিজ, লং আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক ।