Logo

আন্তর্জাতিক    >>   বিডিআর হত্যাকাণ্ড: বিএনপি-জামায়াতের ভূমিকা কি প্রশ্নাতীত থাকতে পারে?

বিডিআর হত্যাকাণ্ড: বিএনপি-জামায়াতের ভূমিকা কি প্রশ্নাতীত থাকতে পারে?

বিডিআর হত্যাকাণ্ড: বিএনপি-জামায়াতের ভূমিকা কি প্রশ্নাতীত থাকতে পারে?

এডভোকেট উম্মে হাবিবা:

পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ভয়াবহতম ও নৃশংস অধ্যায়। এটি শুধু একটি সামরিক বিদ্রোহ ছিল না; বরং সদ্য নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামো এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে একযোগে বিপর্যস্ত করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এ ঘটনার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন আজও জাতির সামনে অনুত্তরিত রয়ে গেছে, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভূমিকা ঘিরে।
বিডিআর বিদ্রোহের আগের দিন থেকে পরবর্তী দুই দিন পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কোথায় ছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর আজও স্পষ্ট নয়। ঘটনার আগের রাতে তারেক রহমান লন্ডন থেকে রাত ১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে ৪৫ বার ফোন করেন এবং সকাল ৬টার মধ্যেই বাসভবন ত্যাগ করতে বলেন—কিন্তু কেন? এসব তথ্য কোনো গুজব নয়; তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সুনির্দিষ্ট কল রেকর্ডের সূত্র ধরে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। বিরোধী দলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরও বিএনপির পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জিয়া ইস্পাহানি বাংলাদেশে এসে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের অনুরোধ করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেই প্রস্তাব দিলে শেখ হাসিনা তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। যে ব্যক্তি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের প্রতি উপহাস করে এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর তার সঙ্গে ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বৈঠকের উদ্দেশ্য কী ছিল? কার আহ্বানে জিয়া ইস্পাহানি বাংলাদেশে এসেছিলেন? আইএসআই ও বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক স্বার্থ যে অভিন্ন—এমন সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনো যুক্তি কি আছে?
পাকিস্তানের আবেদন প্রত্যাখ্যানের পর এবং বিডিআর বিদ্রোহের মাত্র চারদিন আগে জামায়াত নেতা মুজাহিদ দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়। একটি রাষ্ট্রীয় সংকটের প্রাক্কালে তিনি কেন দেশের বাইরে যেতে চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নও আজও জবাবহীন।
নির্বাচনে পরাজিত রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথম দিকে তেমন কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ বিডিআর বিদ্রোহের আগের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সারাদেশ থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার নির্দেশ দেয়। যদি উদ্দেশ্য হতো পরাজয়ের হতাশা কাটিয়ে মনোবল চাঙা করা, তাহলে দলের প্রধান খালেদা জিয়া কেন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন না? দিনের বেলায় সভা শেষ হলেও রাত থেকেই বিডিআর সদস্যদের ক্ষুব্ধ করার অপতৎপরতা শুরু হয়—এটি কি নিছক কাকতালীয়?
হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি দেওয়া সিপাহী মাঈন, সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিকসহ অধিকাংশ অভিযুক্তই বিএনপি আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যাওয়া ২২ জনকে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেপ্তার করা হলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ১৪ জনের চাকরির সুপারিশ করেছিলেন বিএনপির উপমন্ত্রী ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি আব্দুস সালাম পিন্টু। তার সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠী, আইএসআইয়ের ঘনিষ্ঠতা, অস্ত্র পাচার এবং বাংলাভাই ও জেএমবির উত্থানে সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতের তদন্তে উঠে এসেছে। তাহলে কি আগে থেকেই বিডিআরের ভেতরে একটি রিজার্ভ ফোর্স গড়ে তোলা হয়েছিল?
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাঁচ বছর ধরে নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। ২০০৬ সালে সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয় সেনাবাহিনীর দৃঢ় অবস্থানের কারণে। মঈন উদ্দিন আহমেদসহ অনেক সেনা কর্মকর্তা বিএনপির অপকর্ম প্রকাশ্যে তুলে ধরেছিলেন, যা দলটির জন্য ছিল অত্যন্ত বিব্রতকর। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ ২০০৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিডিআর প্রধানসহ যেভাবে নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে, তা বিশেষ নির্দেশ ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সমীকরণে বিএনপি-জামায়াতের ক্ষোভ, প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের সব মুখোশ এখনো উন্মোচিত হয়নি। তবে যেসব প্রশ্ন উঠে এসেছে, সেগুলোর উত্তর না দিয়ে ইতিহাসের দায় এড়ানো যাবে না। রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সত্যের পূর্ণ উন্মোচন আজ সময়ের দাবি।
এডভোকেট উম্মে হাবিবা,নেত্রী, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ।