Logo

রাজনীতি    >>   বঙ্গবন্ধুর চার নীতি ও বাংলাদেশের চার স্তম্ভ—স্বাধীনতার আত্মা ও রাষ্ট্রচেতনার দিকনির্দেশনা: দিলওয়ার হোসেন কয়েস

বঙ্গবন্ধুর চার নীতি ও বাংলাদেশের চার স্তম্ভ—স্বাধীনতার আত্মা ও রাষ্ট্রচেতনার দিকনির্দেশনা: দিলওয়ার হোসেন কয়েস

বঙ্গবন্ধুর চার নীতি ও বাংলাদেশের চার স্তম্ভ—স্বাধীনতার আত্মা ও রাষ্ট্রচেতনার দিকনির্দেশনা: দিলওয়ার হোসেন কয়েস

প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস কেবল একটি ভূখণ্ডের জন্মগাথা নয়—এটি এক মহান আদর্শের বাস্তবায়ন, এক জাতির আত্মপ্রকাশের কাহিনি। সেই আদর্শের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কেবল একটি রাষ্ট্রের জন্মদাতা নন, তিনি নির্মাণ করেছিলেন একটি রাষ্ট্রদর্শন—যার ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি।
এই রাষ্ট্রদর্শনের চারটি স্তম্ভ—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের চার মূলনীতি। এগুলোই বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় “রাষ্ট্রের মূলনীতি” হিসেবে সগর্বে প্রতিষ্ঠিত, যা স্বাধীনতার আত্মাকে ধারণ করে জাতির পথনির্দেশনা প্রদান করে।
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ : আত্মপরিচয়ের ভিত্তি ও স্বাধীনতার মন্ত্র ।
বঙ্গবন্ধুর “বাঙালি জাতীয়তাবাদ” ছিল পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের সরাসরি প্রতিবাদ। তিনি ঘোষণা করেছিলেন—“আমরা প্রথমে বাঙালি, পরে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান।”
এই জাতীয়তাবাদ ধর্ম নয়, বরং ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসভিত্তিক এক আত্মপরিচয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা ধর্মের ভিত্তিতে জাতিকে বিভক্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই বিভাজনের বিপরীতে ঐক্যের দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন—বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলো মুক্তির মূলমন্ত্র, যা জাতিকে একতাবদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধের পতাকাতলে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়—“আমাদের জাতীয়তা বাঙালি; আমরা বাঙালি জাতি। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ভাষা—এই ভিত্তিতেই আমরা এক।”এই জাতীয়তাবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, এবং আজও বাংলাদেশের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু।
২. সমাজতন্ত্র : শোষণহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র কোনো বিদেশি মতবাদ নয়; এটি ছিল বাংলার মাটি ও মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া এক বাস্তবধর্মী দর্শন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সমাজ,“যেখানে মানুষের উপর মানুষের শোষণ থাকবে না, সবাই পাবে ন্যায্য অধিকার।
”সংবিধানের ১০ নং অনুচ্ছেদে তাঁর এই দর্শন স্পষ্টভাবে উল্লেখিত— “রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে মানুষের উপর মানুষের শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি ন্যায়ানুগ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।”বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ছিল মানবমুখী অর্থনীতি—যেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের সেবক, শোষকের নয়। তিনি মেহনতি মানুষের মুক্তি, শ্রমের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সাম্যের পক্ষে আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনের লক্ষ্য ছিল “সবার মুখে হাসি ফোটানো”—এটাই ছিল তাঁর রাজনীতির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য।
৩. গণতন্ত্র : জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা
বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র ছিল শোষিতের গণতন্ত্র, শুধুমাত্র নির্বাচনী কাঠামো নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন—“গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, গণতন্ত্র মানে মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা।”সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে তাঁর এই দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে—“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে।”
তিনি প্রচলিত পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সমালোচনা করে বলেছিলেন, সেই গণতন্ত্র ধনীদের হাতের খেলনা। তাঁর চাওয়া ছিল এমন এক অংশগ্রহণমূলক ও জনগণমুখী গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিটি নাগরিক হবে রাষ্ট্রের মালিক, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার।
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা : সহাবস্থান ও মানবতার শিক্ষা
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন—“বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে—কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।”
তিনি ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে—
“ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার; তাকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা পাপ।”
এই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের আত্মা—যেখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে এক পতাকার নিচে। বঙ্গবন্ধুর এই দর্শনই আজও বাংলাদেশে শান্তি, সাম্য ও মানবতার বার্তা বহন করছে।
চার স্তম্ভে দাঁড়ানো স্বাধীন বাংলাদেশ : বঙ্গবন্ধুর দর্শনের ধারক ও বাহক ।
বঙ্গবন্ধুর চার নীতি শুধু একটি সংবিধানিক ঘোষণাপত্র নয়—এটি বাংলাদেশের আত্মা, রাষ্ট্রচেতনার দিকনির্দেশনা।
•    জাতীয়তাবাদ আমাদের এক করেছে,
•    সমাজতন্ত্র দেখিয়েছে শোষণমুক্তির পথ,
•    গণতন্ত্র দিয়েছে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা,
•    আর ধর্মনিরপেক্ষতা শিখিয়েছে মানুষ হতে।
তিনি বলেছিলেন—
“এই স্বাধীনতা বৃথা যাবে না; এই দেশের মানুষ হাসবে—এটাই আমার স্বপ্ন, এটাই আমার রাজনীতি।”
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা
আজ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ইতিহাস, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকৃত করার অপচেষ্টা চলছে—তখন বঙ্গবন্ধুর এই চার মূলনীতি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
উগ্র মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতা–বিরোধী চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের এই অপচেষ্টা ব্যর্থ হবে—কারণ বঙ্গবন্ধুর দর্শন এই জাতির মেরুদণ্ড।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, এই চেতনাকে রক্ষা করার সংগ্রামে অবিচল। আমাদের প্রত্যেককেই এই ঐক্য ও চেতনার পতাকার নিচে একত্রিত হতে হবে—জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে।বঙ্গবন্ধুর চার নীতি আমাদের সংবিধানের প্রাণ, স্বাধীনতার আত্মা এবং রাষ্ট্রচেতনার চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা।
যদি আমরা এই চার স্তম্ভে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকি, তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব—যেমন তিনি বিশ্বাস করতেন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।

দিলওয়ার হোসেন কয়েস
সাধারণ সম্পাদক, ফ্রান্স আওয়ামী লীগ