Logo

আন্তর্জাতিক    >>   অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের শাসনামলের আমলনামা: গণমাধ্যমের স্মৃতি ‘রি-সেট’ আর ইতিহাস মুছে দেওয়ার ভয়ংকর রাজনীতি

অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের শাসনামলের আমলনামা: গণমাধ্যমের স্মৃতি ‘রি-সেট’ আর ইতিহাস মুছে দেওয়ার ভয়ংকর রাজনীতি

অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের শাসনামলের আমলনামা: গণমাধ্যমের স্মৃতি ‘রি-সেট’ আর ইতিহাস মুছে দেওয়ার ভয়ংকর রাজনীতি

এডভোকেট উম্মে হাবিবা :
“স্বাধীনতার পর কোনো সংবাদপত্র অফিসে কখনো অগ্নিসংযোগ করা হয়নি”—এই বক্তব্য শুনে বিস্মিত হতে হয়। দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিষ্ঠাকাল ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাস বিবেচনায় সম্পাদক মাহফুজ আনামের পক্ষে কখন, কোথায়, কীভাবে সংবাদপত্রে আক্রমণ হয়েছে—তা না জানার কথা নয়। অথচ ইউনুস সরকারের সমর্থনে চলমান তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধ রি-সেট’ প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস ও স্মৃতিও যেন রি-সেট হয়ে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে দৈনিক ইত্তেফাক-এর অফিস ও ছাপাখানা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। সচেতন বা অবচেতনভাবেই হোক—এই ইতিহাস তিনি মনে করতে চাননি। ধরা যাক, তখনো দেশ স্বাধীন হয়নি বলে সেটি তাঁর হিসাবে পড়েনি।
কিন্তু স্মৃতি মুছে যাওয়ার এই ক্ষমতা এতটাই প্রবল যে, একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তাঁদের সমর্থিত মব—যাদের কখনো “জুলাই বিপ্লবী”, কখনো “ছাত্র-জনতা” নামে মহিমান্বিত করা হয়েছে—একাত্তর টিভিতে আগুন দিয়েছে, আটটি গণমাধ্যম ভাঙচুর করে বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি যেসব গণমাধ্যম এখনো চলছে, সেগুলো যে তথাকথিত বিপ্লবীদের দখলে—সেটিও তিনি উল্লেখ করেননি।
কারণ তখন তাদের ভূমিকা ছিল প্রতিবেশীর ঘরে দেওয়া আগুনে আলু পুড়ে খাওয়ার মতো। ধ্বংসযজ্ঞ, অনৈতিকতা আর দেশদ্রোহিতাকে ‘বিদেশি বন্ধুদের সুরে সুর মিলিয়ে’ মনসুন বিপ্লব হিসেবে প্রচার করতেই তারা ব্যস্ত ছিল।
যেভাবে হাদীর নেতৃত্বে মব গায়ের জোরে নানা প্রতিষ্ঠান দখল করেছে—নজরুলের কবর পর্যন্ত—ঠিক সেভাবেই ইতিহাসের এই রক্তাক্ত অধ্যায়ও মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের স্মৃতিতে রি-সেট হয়ে গেছে।
না, ডেইলি স্টার বা প্রথম আলো-তে আগুন দেওয়ায় আমি খুশি নই। বরং সামাজিক মাধ্যমে মাহফুজ আনাম, আপনার “মোহভঙ্গের পর স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া” ছবি দেখে আমি গভীরভাবে বিচলিত হয়েছি। আমি ক্ষুব্ধ—যদিও একটি হাস্যময় ছবি শেয়ার করেছি।
আপনারা এতদিন জামায়াতকে তোষামোদ করেছেন, এখন বিএনপিকেও করতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ ও চৌদ্দ দলের সঙ্গে আপনাদের ঠেলাঠেলি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়—তা এখনো স্পষ্ট নয়।
শ্রদ্ধেয় মাহফুজ আনাম, আপনি প্রশ্ন করেন—“আমার কী দোষ?”
দোষ নয় মহোদয়, আপনারা করেছেন এক অমোচনীয় ভুল। স্বাধীন গণমাধ্যমের দাবিদার হয়ে এমন একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, যারা ইসলামিক শরিয়া চায়; এবং তাদের সঙ্গে মিলে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশকে অরাজনৈতিক ও বেআইনি শক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন।
এখানেই আপনারা থামেননি। গত সতেরো মাস ধরে সেই গোষ্ঠীর ন্যারেটিভ অনুযায়ী দেশকে বিরাজনীতিকরণের নামে ক্ষমতাচ্যুত দলের নেতাকর্মীদের দেশজুড়ে ও জেলখানায় হত্যা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনাদের হিরণ্ময় নীরবতা ছিল চোখে পড়ার মতো। আপনাদের রেটোরিক, প্রতিবেদনের শুরু ও শেষ—সবকিছুতেই দেখা গেছে কাকে মহান বানানো হচ্ছে, কাকে শয়তান করা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও সংবিধানিক স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে—আর আপনারা উল্টো রাজ্যের গল্প রচনা করে গেছেন, ছেপে গেছেন।
আপনারা শুধু বিরাজনীতিকরণের বয়ান ছাপিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং সেই অপশক্তির পক্ষে সামাজিক কনসেনসাস তৈরি করেছেন। সন্ত্রাসকে বিপ্লব বলা হয়েছে। নেপাল সাত দিনের মধ্যেই এই তফাৎ বুঝেছিল। বাংলায় জনগণকে কে মিসগাইড করেছে? আপনাদের মাধ্যমগুলোই।
সমাজের সচেতন অংশ যখন পতিত হয়, তার মাশুল দেয় সাধারণ মানুষ ও পুরো জাতি। আপনাদের দায়িত্ব যে কত বড়—এই জাতি আপনাদের ওপর কতটা ভরসা করত—সেটা কি কখনো উপলব্ধি করেছেন?
এর ফলাফল আজ স্পষ্ট—
দিশাহারা জনগণের নিস্তব্ধতা,
সমাজবিরোধীদের চড়া গলা,
আর শিবিরের নেতা চাইনিজ কুড়াল হাতে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫-এর রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর সামনে টেররের মূর্ত প্রতীক হয়ে হাজির হওয়া এবং আগুন নিয়ে হোলিখেলা।
ওরা বোঝে না দেশ কী হারাল। কারণ ওদের লক্ষ্য গণতন্ত্র বা স্বাধীনতা নয়—ওদের লক্ষ্য দেশকে পূর্ব পাকিস্তান বানানো, ১৯৭১ ‘কারেক্ট’ করা। এই খেলায় আপনারা ওদের দাবার দামী গুটি হয়েছেন।
আজ আমরা দেখছি—বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা আঁকতে নিষেধ, গোলাম আযমের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ, আর গণমাধ্যমে ঘোষণা—“বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য।”
রাজনীতি ও সমাজনীতির যে অসুস্থ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আপনাদের লড়ার কথা ছিল, সেখান থেকে সরে যাওয়ার পর গণমাধ্যমসহ দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের পতন অনিবার্যই ছিল।
গণমাধ্যম আজ আর ‘ফিফথ স্টেট’ নয়; বরং ‘ফিফথ কলাম’ হয়ে বাংলার জন্ম-ইতিহাস বদলে দেওয়ার ন্যারেটিভের অংশীদার।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার যেভাবে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ‘পঞ্চম কলাম’ বলত—গত সতেরো-আঠারো মাসে সেই একই ভাষ্য কি আমাদের গণমাধ্যমে বারবার শোনা যায়নি?
তাই বলতে হয়, বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমকর্মী সেই ‘ফিফথ কলাম’ অভিধার যোগ্য। তাদের ভূমিকার জন্য ধিক্কার প্রাপ্য।
তবু বলি—গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমি আপনাদের পাশেই আছি। জেলে থাকা, কর্মহীন, পাস বাতিল হওয়া ও নিহত সাংবাদিক সহকর্মীদের জন্য আপনারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন—তা জানতে চাই।
আমি বিশ্বাস করি, আপনারা আবার ফিরে দাঁড়াতে পারবেন। কিন্তু অনুরোধ—বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না।
গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে থাকতে চাইলে হাদীর মতো মব সর্দারকে মাথায় তোলা যাবে না। রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির বয়ান নয়—দেশের মর্যাদার ন্যারেটিভ আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরুন। আর সে বয়ান ছাপাতে হলে তার সঙ্গে আপনাদের নিজস্ব বিশ্লেষণ যুক্ত করুন।
নইলে আপনাদের ও আপনাদের বৈদেশিক বন্ধুদের আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন কেবল মরীচিকাই হয়ে থাকবে।
আইন, দেশ, মানবাধিকার ও ফ্রি-স্পিচকে এখন মজলুম সাজা শয়তানের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।
সঠিক জায়গায় লড়ুন।
— এডভোকেট উম্মে হাবিবা
কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের অন্যতম নেত্রী