Logo

আন্তর্জাতিক    >>   ১৭ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তা—এক ভয়াবহ আমলনামা

১৭ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তা—এক ভয়াবহ আমলনামা

১৭ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তা—এক ভয়াবহ আমলনামা

ডাঃ সুলতানা শামীমা চৌধুরী রিতা : 
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিগত ১৭ মাসের শাসনামল দেশের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ক্ষমতা গ্রহণের আগেই ড. মুহাম্মদ ইউনুস ফ্রান্সের মাটিতে বসে ভারতের “সেভেন সিস্টার” অঞ্চলকে অস্থির করার বক্তব্য দিয়ে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আসার পর তারই বাস্তব প্রতিফলন আজ বাংলাদেশে।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই যে পাকিস্তান ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশকে শাসন-শোষণ করেছে এবং ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছে, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন, এমনকি আইএসআই-এর ঘাঁটি স্থাপনের অভিযোগও উঠে আসে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অবৈধভাবে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চুক্তি করা হয়—যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের সংবিধানে নেই—এটি একটি সাংবিধানিক সত্য। তবুও সরকার প্রধান “ঐতিহাসিক নির্বাচন” দেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে রাষ্ট্রের প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটারকে বাদ দিয়ে একটি সাজানো ও পাতানো জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশে চরম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। চারদিকে মব সন্ত্রাস, হত্যা, নৈরাজ্য অব্যাহত। মৌলবাদী, উগ্রপন্থী ও জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থান আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে—কিছু সন্ত্রাসীকে পরিকল্পিতভাবে জেলখানা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এবং এসব শক্তিকে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ফলে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা আজ চরম হুমকির মুখে।
সাধারণ মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভূমিদখল এখন নিত্যদিনের ঘটনা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কার্যত বিলুপ্ত। বিচার বিভাগ অসহায়—নীরবে কাঁদছে ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর।
এই সময়ে প্রায় ৮০টি পবিত্র মাজার শরীফে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২ হাজার মন্দিরে একই ধরনের বর্বরতা চালানো হয়েছে। শত শত সাংবাদিককে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে এসেছে চরম দমন-পীড়ন। জেলখানায় আওয়ামী লীগের ১২৪ জন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বহু সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও নেতাকর্মীর বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চলছে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটি তিনবার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—যা জাতির ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত। কয়েক লক্ষ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
দেশে এমন নৃশংসতা দেখা গেছে—জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে আগুনে পোড়ানো। দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। নারী সমাজকে গৃহবন্দী করে রাখার সুপরিকল্পিত অপচেষ্টাও স্পষ্ট।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও দেশ বিপর্যস্ত। শত শত মিল-ফ্যাক্টরি ও গার্মেন্টস শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান হারিয়ে যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য দেশছাড়া হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার, অর্থনীতি চরমভাবে ভঙ্গুর।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়—এশিয়া উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, যার প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোটার ও লক্ষ লক্ষ কর্মী-সমর্থক রয়েছে, তাদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৪ দলসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দলকেও নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।
অথচ আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিএনপিকে বারবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। তারা অংশ না নিলেও নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ করা হয়নি। আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকাশ্যেই বলছে—আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।
সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকার জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে দেখতে চায়। অথচ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী ও গণহত্যায় সম্পৃক্ত জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে—আর মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ পাবে না—এটি ইতিহাস ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে নির্মম প্রহসন।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা একটাই—অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেখানে সকল রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে এবং জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটবে।
— ডাঃ সুলতানা শামীমা চৌধুরী রিতা, বিশিষ্ট সমাজসেবিকা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক