Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামো: মধুসুদন কৃষ্ণ দাস

মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামো: মধুসুদন কৃষ্ণ দাস

মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামো: মধুসুদন কৃষ্ণ দাস

Progga News Desk:

মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামো: মধুসুদন কৃষ্ণ দাস

মহাভারতের যুগ দ্বাপর যুগের একটি অংশ মাত্র। এই যুগের আয়ু ৮,৬৪,০০০ সৌর বছর ধরা হয়। এই যুগেই কুরুক্ষেত্রে কুরু এবং পাণ্ডবদের মধ্যে এক মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং সেই যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে সাতজন এবং কুরুপক্ষে তিনজন যোদ্ধা মাত্র জীবিত ছিলেন। পাণ্ডব পক্ষে যুধিষ্ঠির ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি এবং যুযুৎসু (ধৃতরাষ্ট্রের উপপত্নীর গর্ভজাত পুত্র যিনি যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে যুধিষ্ঠির-এর আহ্বানে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেন)। কৌরব পক্ষে জীবিত ছিলেন | কৃতবর্মা (যদুবংশীয় একজন রাজা যিনি অর্জুন অনুরোধ না করায় অভিমানবশত কুরুপক্ষে যোগদান করেন) কৃপাচার্য (করুপান্ডবের প্রথম অস্ত্র গুরু দ্রোণাচার্যের সম্বন্ধী-দ্রোণাচার্য কৃপাচার্যের বোন কূপীকে বিবাহ করেছিলেন) এবং অশ্বত্থামা (অস্ত্র গুরু দ্রোণাচার্যের পুত্র যিনি চার যুগের অমরত্ব লাভ করেছিলেন)।

আধুনিক যুগের মত সেকালে নৌ বাহিনী ছিল না। তবে বিমান বাহিনী ছিল। সে যুগে বিমানে চড়ে যুদ্ধের উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়। তবে রাজন্যবর্গের মধ্যে যে সব যুদ্ধ হতো তা ছিল মূলতঃ সেনাবাহিনী ভিত্তিক। আধুনিক যুগের মতো তৎকালীন সময়েও সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামো সুশৃঙ্খল ছিল। যুদ্ধাস্ত্র এবং যুদ্ধ কৌশল ছিল উন্নত মানের।

মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামো আধুনিক যুগের কাঠামো অপেক্ষা আরোও বিস্তৃত এবং উন্নত ধরনের ছিল বলা যায়। আধুনিক যুগে বেশীরভাগ দেশেই সেনাবাহিনীর সর্বনিম্ন স্তরকে প্লাটুন বলা হয়। অনেক দেশে সাধারণতঃ একজন হাবিলদার বা সুবেদার মেজর প্লাটুনের সেনাধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োজিত থাকে। এক প্লাটুনে ৪০- ১০০ সৈন্য থাকে । প্লাটুনের আকার বড় হলে একজন সেকেণ্ড লেফটানেন্ট অথবা লেফটানেন্টকে এর পরিচালনার জন্য নিয়োজিত করা হয়। মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর সর্বনিম্ন ইউনিটকে পত্তি বলা হত। ১টি হাতি, ১টি রথ, ৩টি ঘোড়া এবং ৫জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে এক পত্তি গঠন করা হত। তিন পত্তিতে এক সেনামুগ এবং তিন সেনাযুগ নিয়ে এক গুল্ম গঠন করা হতো। ফলে এক গুল্মে ৯টি হাতি, ৯টি রথ, ২৭ টি ঘোড়া এবং ৪৫ জন পদাতিক সৈন্য থাকতো। এই গুল্মকেই বর্তমান যুগের প্লাটুনের সমকক্ষ বলা যায়।

আধুনিক যুগে একাধিক প্লাটুন নিয়ে একটা কোম্পানী গঠন করা যায়। কোম্পানীতে সৈন্য সংখ্যা কম হলে একজন ক্যাপ্টনকে এর অধিনায়ক করা হয়। তবে সৈন্য সংখ্যা বেশী হলে জুনিয়র মেজর পদবিধারী সৈন্যাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়। এই কোম্পানী মহাভারতের যুগের সেনাবাহিনীর “গণ" ইউনিট এর সমতুল্য বলা যায়। 'গন' ইউনিট ৩টি গুলোর সমন্বয়ে ঐ সময় গঠন করা হতো। সাধারনত : ২৭টি হাতি, ২৭টি অশ্ব, ৮১ টি ঘোড়া এবং ১৩৫ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে একটি গন ইউনিট গঠন করা হতো।

বর্তমান যুগে একাধিক কোম্পানী নিয়ে সেনাবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন গঠন করা হয়। এর অধিনায়ক হিসাবে একজন সিনিয়র মেজর বা লেঃ কর্নেলকে নিয়োগ করা হয়। এতে ৪০০-৮০০ সৈন্য থাকতে পারে। মহাভারতের যুগের

সেনাবাহিনীর “বাহিনী” নামক ইউনিট এর সমতুল্য ধরা যায়। কারণ ৩টি গন ইউনিট নিয়ে একটি বাহিনী সেই যুগে গঠন করা হতো। এতে ৮১ টি হাতি, ৮১ টি রথ, ২৪৩ টি ঘোড়া এবং ৪০৫ জন পদাতিক সৈন্য থাকতো । আধুনিক যুগে ব্যাটেলিয়ন নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি একাধিক রেজিমেন্ট গঠিত হয়। সাধারণতঃ একজন কর্নেল রেজিমেন্টের পরিচালনায় নিয়োজিত থাকেন। মহাভারতের যুগের সেনাবাহিনীর ইউনিট “পুতনা” এর সাথে এর তুলনা করা যায় যেখানে কমপক্ষে ১২১৫ জন পদাতিক সেনা থাকতো। একাধিক রেজিমেন্ট নিয়ে আধুনিক যুগে সেনাবাহিনীর ব্রিগেড গঠিত হয়। একজন ব্রিগেডিয়ার অথবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়। সাধারণত ৩ থেকে ৪ হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে ব্রিগেড গঠন করা হয়। মহাভারতের যুগের সেনাবাহিনীর  ইউনিট “চমু” এর সাথে এটি তুলনীয় হতে পারে যেখানে কমপক্ষে ৩৬৪৫ পদাতিক সৈন্য থাকতো।

আধুনিক যুগে একাধিক ব্রিগেড নিয়ে এক একটি ডিভিশন গঠিত হয়। ডিভিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। একজন মেজর জেনারেল। মহাভারতের যুগে সেনা বাহিনীর ইউনিট “অনিকিনীর” সাথে এর তুলনা করা যায় যেখানে কমপক্ষে ১০৯৩৫ জন পদাতিক সৈন্য ছিল।

বর্তমান যুগে একাধিক ডিভিশন নিয়ে সেনাবাহিনীর কোর গঠন করা হয়। কোর-এর দায়িত্বে সাধারণত একজন লেফটেনান্ট জেনারেল থাকেন। একাধিক কোর নিয়েই পুরো সেনাবাহিনী গঠিত হয় । মহাভারতের যুগের সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ইউনিট অক্ষৌহিনী এর আবার আধুনিক যুগের কোর ইউনিটের মতই ছিল । এক অক্ষৌহিনী'তে ২১৮৭০ টি হাতি, ২১৮৭০ টি রথ, ৬৫৬১০ টি ঘোড়া এবং ১০৯৩৫০ জন পদাতিক সৈন্য থাকতো।

যুগের কোর কমান্ডার আধুনিক মহাভারতের যুগের অক্ষৌহিনীর অধিপতির সমতুল্য বলা যায় । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কৌরব পক্ষে ১১ অক্ষৌহিনী এবং পান্ডব পক্ষে ? অক্ষৌহিনী সৈন্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। যেমন-পান্ডব পক্ষে প্রতিটি অক্ষৌহিনীর বিপরীতে একজন করে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এরা ছিলেন- পাঞ্চাল অধিপতি দ্রাপদ রাজা, মৎস দেশের রাজা বিরাট, যদু বংশের সাত্যকি, দ্রুপদ পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, মহারাজ ধৃষ্টকেতু, দ্রাপদপুত্র শিখন্ডি এবং মগধরাজ মহাদেব। আবার কৌরব পক্ষে অক্ষৌহিনী অধিপতি হিসাবে প্রাগজ্যোতিষপুরের মহারাজ মদ্রাধিপতি শল্য, যদু বংশের কৃতবর্মা, কম্বোজের রাজা সুদক্ষিণ, সিন্ধুদেশের রাজপুত্র দুর্যোধনের ভগ্নিপতি জয়দ্রথ প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের সময় এদের এক এক জন এক এক দিকের সৈন্য এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ভগদত্ত,আধুনিক যুগের মতোসেকালেও বৃহৎ যুদ্ধে সেনাধ্যক্ষ থাকতেন। তাদেরকে বর্তমান যুগের চার অথবা পাঁচ তারকা বিশিষ্ট জেনারেলদের সাথে তুলনা করা যায়। যেমন পাণ্ডব পক্ষে সাতজন সেনাপতি থাকলেও ধৃষ্টদ্যুম্নকে সব সেনাপতি পদে যুধিষ্ঠির নিয়োগ করেছিলেন। তবে এই সেনাধ্যক্ষ কোন কারণে মৃত্যু বরণ করলে তার স্থলে সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হতো।

যেমন কৌরব পক্ষে ভীষ্ম প্রথমে ১০ দিনের জন্য, দ্রোণাচার্য ৫ দিনের জন্য, কর্ণ ২ দিনের জন্য এবং মহারাজ শল্য ১ দিনের জন্য সেনাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান যুগে সেনাবাহিনীর সর্ব্বোচ্চ উপাধি হল ফিল্ড মার্শাল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিপক্ষ সেনাদলকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করতে পারলে সাধারণতঃ এরূপ উপাধি কোন সেনাধ্যক্ষ পেয়ে থাকেন।

যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-বাহিনীর পরাজয় আত্মসমর্পনের এবং কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আফ্রিকায় অসাধারণ নৈপুন্য দেখানোর জন্য জার্মান জেনারেল রোমেলকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়েছিল। এই ধরণের বীর সেনানী মহাভারতের যুগেও পরিলক্ষিত হয় যারা একক যুদ্ধে বিপক্ষদলের সম্পূর্ণ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয় । উদাহরণ হিসাবে মহামতি অর্জুন এবং মহাবীর ভীস্মের নাম করা যায়। ভীস্ম বিচিত্রবীর্যের তার বৈমাত্রেয়

বিবাহের জন্য কাশী রাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে বরণকালে সমবেত রাজন্যবর্গ একযোগে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও তিনি একাই সবাইকে পরাজিত করেন। আবার মৎসদেশে বিরাট রাজার গৃহে অজ্ঞাতবাসকালে কৌরবরা যখন ঐ দেশের গরু হরণ করে তখন বৃহন্নলাবেশী অর্জুন একাই কৌরব সেনাদেরকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হন। এই দুইজন মহাযোদ্ধাকে তাই আধুনিক যুগের ফিল্ড মার্শালের সমতুল্য বলা যায় ।

প্রতাপশালী এবং বড় যোদ্ধা ছিলেন তাদেরকে আবার মহারথ, অতিরথ, রথী এবং এমনকি অর্ধরথী হিসাবেও অভিহিত করা হতো। যেমন ভীস্ম, দ্রোনাচার্য, অশ্বত্থামা, অর্জুন এরা ছিলেন মহারথী, কর্ণ ছিলেন অর্ধরথী ইত্যাদি । সাধারণ পাঠকদের জানার সুবিধার্থে মহাভারতের যুগে সেনাবাহিনীর গঠন কাঠামোর একটি রূপরেখা নীচে দেখানো হলঃ