Logo

আন্তর্জাতিক    >>   পহেলা বৈশাখের সংকট এবং বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

পহেলা বৈশাখের সংকট এবং বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

পহেলা বৈশাখের সংকট এবং বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

নয়ন বিশ্বাস রকি,প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশ একটি জাতি হিসেবে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। আমাদের স্বাধীনতা একদিনে আসেনি, এই ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি মুক্তিযোদ্ধার রক্তে সিক্ত। সেই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে কাজ করেছিল একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, ও প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই চেতনাই পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় ক্যালেন্ডারে একটি বিশেষ স্থান এনে দেয়—পহেলা বৈশাখ, যা কেবল একটি বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নয়, বরং জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিন।

বছরের প্রথম দিনটি বাঙালির জন্য ছিল প্রাণের উৎসব, সংস্কৃতির মিলনমেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কো স্বীকৃত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে। কিন্তু আজ, দুঃখজনকভাবে, সেই পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে স্তব্ধতা আর আতঙ্কের মধ্যে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিল, রমনার বটমূলে সঙ্গীত নেই, রাজপথে নেই মানুষের ঢল। এটা কেবল একটি অনুষ্ঠানের বন্ধ হওয়া নয়, এটা একটি জাতির সাংস্কৃতিক ও মননশীল পরিচয়ের ওপর পরিকল্পিত আঘাত।

গত পহেলা বৈশাখে আমি আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ের জন্য শাড়ি কিনতে বের হই। শপিংমল থেকে শপিংমল, প্রায় ৫০টির মতো দোকানে ঘুরেও ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী শাড়ি পাইনি। দোকানিরা জানাল—এখন আর চাহিদা নেই, উৎসব নেই, মানুষ কিনে না। এই কথাগুলো শোনার পর মনে হলো—আমরা কি সত্যিই স্বাধীন দেশে আছি? না কি কোনো অদৃশ্য আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছি?

বাংলাদেশে বর্তমানে যেভাবে সংস্কৃতি, উৎসব, ইতিহাসকে পেছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। পাকিস্তানপন্থী রাজাকার-আলবদর চেতনার উত্তরসূরিরা নানা ছদ্মবেশে আজ সক্রিয়। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, গুজব ছড়িয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে জাতির মূল চেতনা—মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাঙালিয়ানা—সব কিছুকে মুছে ফেলতে চায়।

আজকে যারা পহেলা বৈশাখ নিয়ে বিরোধিতা করছে, তারাই একসময় একুশে ফেব্রুয়ারি ও বিজয় দিবসের বিরুদ্ধেও ছিল। তারা কখনোই চায়নি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হোক, তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। আজকের বাস্তবতায়, যখন জাতির অভ্যন্তরে এই অশুভ শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐক্য—মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে একতাবদ্ধ করে দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা।

এই কঠিন সময়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক নন, তিনি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উন্নয়নের ধারক-বাহক। তাঁর নেতৃত্বে পদ্মা সেতু হয়েছে, মেট্রোরেল এসেছে, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তব হয়েছে। কিন্তু এই অগ্রগতির মাঝেও বারবার তাঁর জীবনের ওপর হুমকি এসেছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ২০০৪ সালের ষড়যন্ত্র—সবই ছিল তাঁকে হত্যা করে বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিক্ষেপের পরিকল্পনা। আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি বেঁচে আছেন এবং দেশের হাল ধরেছেন।

আজ যখন পহেলা বৈশাখ বন্ধ, তখন কেবল শোকের নয়, প্রতিরোধের সময়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শক্তি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ এবং দেশের প্রতিটি শুভবোধসম্পন্ন মানুষকে দাঁড়াতে হবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে।

আমরা চাই, আগামী দিনে আবার রাজপথে গর্জে উঠুক মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলার আকাশে বাজুক ‘এসো হে বৈশাখ’ সঙ্গীত। দোকানে দোকানে ফিরে আসুক বৈশাখী শাড়ি, পাঞ্জাবি, মুখর হোক বাংলার প্রতিটি জনপদ।

পহেলা বৈশাখের প্রকৃত চেতনা ফিরিয়ে আনার লড়াইটা আমাদের সবাইকে একসাথে করতে হবে—কারণ এ লড়াই কেবল সংস্কৃতির জন্য নয়, এ লড়াই আমাদের জাতিসত্ত্বা, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার।

নয়ন বিশ্বাস রকি,
 সাবেক ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
রাজনৈতিক কলামিস্ট ও বিশ্লেষক ।