
আইপিএল; সমর্থকেরা কি ভারতীয় ক্রিকেটে বিষাক্ত সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে?
Progga News Desk:
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ক্রিকেটকে বাণিজ্যিকভাবে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিলেও, এর ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক কাঠামো হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই জন্ম দিয়েছে এমন এক সংস্কৃতির, যেখানে খেলোয়াড়দের অপমান করাটাও যেন আবেগ প্রকাশের একটা নতুন উপায়।
অপমানজনক নামে ডাকা
ভারতীয় ক্রিকেটের তিন মহারথী—বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি ও রোহিত শর্মা। শুধু ভারত নয়, ক্রিকেট ইতিহাসেই যাঁরা প্রত্যকে আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবেন। অথচ আইপিএল আসার পর তাঁদের এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডাকা হচ্ছে ‘চোকলি’, ‘ধোবি’ ও ‘বড়পাও’ ইত্যাদি নামে। কাজটা আসলে করছেন এই ক্রিকেটাররা যে দলে খেলেন, তার প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকেরা।
বিরাট কোহলিকে ইদানীং ‘চোকলি’ নামে ডাকছেন অনেক প্রতিপক্ষ সমর্থক, কখনো কখনো তাঁর নিজের দলের সমর্থকেরাও। নামটা এসেছে আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে বিভিন্ন সময় চাপের মুখে কোহলির ‘চোক’ করা থেকে। অথচ ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ‘চেজ মাস্টার’ মনে করা হয় কোহলিকে।
ধোনিকে তার প্রতিপক্ষ সমর্থকেরা ‘ধোবি’নামে ডাকে যার মানে ধোপা। ধোনিকে কেন প্রতিপক্ষ সমর্থকেরা এই ব্যঙ্গাত্মক নামে ডাকেন, বলা মুশকিল। অথচ ধোনি ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন। তাঁর নেতৃত্বেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ (২০০৭), ওয়ানডে বিশ্বকাপ (২০১১), এবং চ্যাম্পিয়নস ট্রফি (২০১৩) জিতেছে ভারত।
আবার রোহিত শর্মার শারীরিক গঠনকে কটাক্ষ করে তৈরি ডাকনাম ‘বড়পাও’— যা আসলে মুম্বাইয়ের একটা বিখ্যাত খাবার। অথচ রোহিত শুধু ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজনই নন, ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ে।
আইপিএল যখন শুরু হয়, তখন এর উদ্দেশ্য ছিল ক্রিকেটকে আরও জনপ্রিয় ও বাণিজ্যিকভাবে সফল করে তোলা। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি সংস্কৃতি ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকদের সেই ঐক্য ভেঙে দেয়। শুরু হয় কাঁদা–ছোড়াছুড়ি। এক সময় যাঁরা শুধুই ‘টিম ইন্ডিয়া’-কে সমর্থন করতেন, তাঁরা এখন ভাগ হয়ে পড়েছে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা বা বেঙ্গালুরুর পরিচয়ে।
সমর্থকেরা এখন শুধু খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স দেখে নয়, তাঁদের ফ্র্যাঞ্চাইজি পরিচয় দেখে ভালোবাসছেন বা ঘৃণা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি হয়েছে ‘আমরা বনাম ওরা’ সংস্কৃতি, যেখানে যুক্তি ও সম্মানের কোনো স্থান নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেক অ্যাকাউন্টগুলো থেকে নির্দ্বিধায় অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে—তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাওয়ায় সমর্থকদের প্রত্যাশা পৌঁছে গেছে অবাস্তব এক মাত্রায়। প্রতিটি ম্যাচেই তাঁরা চান নিখুঁত পারফরম্যান্স, যেন খেলোয়াড়েরা রোবট!
সমালোচনা অবশ্যই সমর্থকদের অধিকার। কিন্তু সেটি যখন অপমানের রূপ নেয়, তা বিষাক্ত হয়ে যায়। ভালোবাসার সংস্কৃতি তৈরি করতে গেলে দরকার হয় সম্মান ও শ্রদ্ধা। ক্রিকেট যেমন কৌশল ও প্রতিভার খেলা, তেমনি আবেগ ও সম্মানেরও খেলা। আইপিএল ক্রিকেটে নতুন রং এনেছে। বিশ্বব্যাপী এর লাখো-কোটি দর্শক, অনুসারী। ভারত ছাড়াও সেখানে ক্রিকেট বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় ক্রিকেটাররা খেলেন। সমর্থকদের যতটা আবেগ এখানে জড়িত, ততটাই কিংবা তার চেয়ে বেশি হয়তো ক্রিকেটারদের। সেই ক্রিকেটাররা অসম্মানিত হলে তো ক্রিকেটই অসম্মানিত হয়।