Logo

আন্তর্জাতিক    >>   মুজিবনগর সরকার; মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি

মুজিবনগর সরকার; মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি

মুজিবনগর সরকার; মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি

নয়ন বিশ্বাস রকি, প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকার, যা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার” বা “প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার” নামেও পরিচিত, ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই সরকারের গঠন ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি, যার মাধ্যমে জাতি এক ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের অধীনে দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বিজয় অর্জন করে।

                    মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের সম্মানে নির্মিত ভাস্কর্য

 

স্বাধীনতার ঘোষণা ও প্রয়োজনীয় প্রেক্ষাপট-

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় চালায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের পরিকল্পিত গণহত্যা ও দমনপীড়নের এক ভয়াবহ অভিযান। রাতারাতি ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে, ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন (যদিও তিনি ঐ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়)।

দেশে চলমান সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নেতৃত্বের অভাব পূরণের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক সরকারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার।

                   মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের ঐতিহাসিক মুহূর্ত

 

গঠন ও শপথ গ্রহণ-

১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল ভারতের সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমানে মুজিবনগর) নামক স্থানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই অস্থায়ী সরকার।
এরপর ১৭ই এপ্রিল বৈদ্যনাথতলাতেই এই সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে গোটাবিশ্বের সামনে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সরকার আত্মপ্রকাশ করে।

                 মুজিবনগর সরকার: মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি

এই সরকারে:
•    রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (তাঁর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম),
•    প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ,
•    অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী,
•    গৃহমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান।

সরকারের মুখ্য কার্যাবলি ও অবদান-

১. মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও সামরিক কাঠামো:
মুজিবনগর সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধ বাহিনীকে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত ও সমন্বিত করে। এই সরকারের অধীনেই গঠিত হয় “মুক্তিবাহিনী”, যার মধ্যে পূর্ববাংলার সেনা, ইপিআর, পুলিশ এবং সাধারণ তরুণ-তরুণীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

২. কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:
এই সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলে। যুদ্ধকালীন সময়ে ভারত সরকার মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিত্ব মেনে নিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।

৩. প্রচার ও জনমত গঠন:
মুজিবনগর সরকার ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গড়ে তোলে — যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে খবর, অনুপ্রেরণামূলক গান ও বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এতে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের মনোবল চাঙ্গা রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৪. ত্রাণ ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনা:
ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছিল এই সরকার। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য এনে, মুজিবনগর সরকার শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

যুদ্ধ ও বিজয়ের পথে
মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে এবং ভারতের সরাসরি সহায়তায় ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলে। একদিকে মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য গেরিলা দল, অন্যদিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী — এক যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব-
মুজিবনগর সরকারের অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এই সরকার গঠন না হলে হয়তো বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ দীর্ঘমেয়াদি স্বাধীনতার রূপ নিতে পারত না। সরকার হিসেবে এই সংগঠন মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক শক্তির রূপ দেয়। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার ন্যায্যতা তুলে ধরতে এটি ছিল মূল চালিকা শক্তি।

মুজিবনগর সরকার কেবল একটি সরকার ছিল না; এটি ছিল জাতির আশা, বিশ্বাস ও মুক্তির প্রতীক।
এটি ছিল এমন এক নেতৃত্ব, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়েও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল, জয় এনে দিয়েছিল। এই সরকার আজও প্রমাণ করে — সংকটময় সময়েও সঠিক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব একটি জাতিকে ইতিহাসে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

নয়ন বিশ্বাস রকি 
কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।