
ডোনান্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে এবার কি পেলেন না নেতানিয়াহু?
Progga News Desk:
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু লম্বা তালিকা নিয়ে তড়িগড়ি ওয়াশিংটন সফরে গেছেন। এই তালিকায় তাদের অন্যতম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে—ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ, সিরিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ১৮ মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধ।
দেখে মনে হচ্ছে, দুই মাস আগে তাঁর ওয়াশিংটন সফরের কথা চিন্তা করলে ট্রাম্পের সঙ্গে গত সোমবারের বৈঠক থেকে অনেকটা খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে। ওভাল অফিসে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে নেতানিয়াহু তাঁর বিশেষ অগ্রাধিকার নীতি নিয়ে আলোচনায় ট্রাম্পের পক্ষ থেকে হয় তিরস্কার শুনেছেন, নয় তো তাঁর নীতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের কথা শুনেছেন।
গত মঙ্গলবার আইসিসির পরোয়ানাভুক্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠককে সফল বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, ‘খুবই ভালো সফর’ হয়েছে। তিনি সব ক্ষেত্রে এই সফরকে সফল বলে দাবি করেন।
তবে ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল বুঝতে পারছে, এই সফর তাদের জন্য কতটা কঠিন ছিল। ওই সফরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমনই ইঙ্গিত দিলেন।
ইসরায়েলের ইয়েদিয়ত আহরোনোত দৈনিকের বিশ্লেষক নাদাভ ইয়াল বলেন, আসলে নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে যা শোনার আশা করছিলেন, তেমনটা তিনি শোনেননি। তিনি বলেন, দুই নেতার মধ্যে মতানৈক্য সত্ত্বেও সফর অবশ্যই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।
নেতানিয়াহু খুব অল্প সময়ের নোটিশে ট্রাম্পের এই মেয়াদে দ্বিতীয়বারের মতো ওয়াশিংটনে ‘তীর্থযাত্রা’ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের (পরে অবশ্য শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়) বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন বলে আপাতদৃষ্টে মনে হয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এমন এক উত্তাল সময়ে তাঁর এই সফর নিশ্চয় কেবল শুল্কে আটকে থাকতে পারে না।
ট্রাম্পের উদ্যোগে নতুন যুদ্ধিবিরতি ভেঙে ইসরায়েল গত মাসে নতুন করে গাজায় হামলা শুরু করেছে। একই সময়ে পরামাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ছে।
নেতানিয়াহু ও তাঁর ইসরায়েলি মিত্ররা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের ফিরে আসায় বেশ রোমাঞ্চিত ও উৎফুল্ল ছিলেন। কারণ, প্রথম মেয়াদেও ট্রাম্প তাদের শক্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন। এবার ক্ষমতায় ফিরে ট্রাম্প কেবল ইসরায়েলপন্থী কর্মকর্তাদের তাঁর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনেননি, বরং তিনি বাইডেন প্রশাসনে যাঁরা ইসরায়েলের গাজা ও পশ্চিম তীর হামলার ঘোর সমালোচক ছিলেন, তাঁদের সরকার থেকে বিদায় করে দিয়েছেন।গত সোমবারের বৈঠক আবারও দেখিয়ে দিল, ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্কটা হবে বেশ জটিল ও অনিশ্চিত। যেমনটা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী হয়তো প্রত্যাশাও করেননি।
নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ওপর সামরিক চাপ প্রয়োগ করার জন্য বলে আসছেন। নেতানিয়াহুর উৎসাহে ২০১৮ সালে ট্রাম্প একতরফাভাবে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী ছয় দেশের সঙ্গে ইরানের চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে ওবামা প্রশাসন ওই চুক্তি করিয়েছিল।
তখন নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে কলঙ্কিত করেছিলেন। কারণ, তিনি বলেছিলেন, ইরানকে দমিয়ে রাখার জন্য বা আঞ্চলিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থন বন্ধ করতে এই চুক্তি যথেষ্ট নয়।
নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ইরানকে পরমাণু অস্ত্র পাওয়া থেকে বিরত রাখতে হলেসামরিক চাপ হলো সবচেয়ে ভালো উপায়। ইসরায়েল গত বছর সরাসরি ইরানে হামলা চালায়। তবে ইরানের সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানতে পারেনি। ইরানের ভূগর্ভে পরিচালিত পরমাণু স্থাপনায় হামলার জন্য তাই ইসরায়েলের দরকার মার্কিন সামরিক বাহিনীর সহায়তা।
ট্রাম্প গত সোমবার নেতানিয়াহুকে জানিয়ে দিয়েছেন, ইরান আলোচনায় রাজি না হলেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। একই দিন তিনি ঘোষণা দিয়ে বসলেন, এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আলোচনায় বসছে। এতে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর চেহারাটা কিছুটা ম্রিয়মান হয়ে যায়।
দুই নেতাই ইরানকে পরমাণু অস্ত্র বানাতে না দিতে সম্মত হয়েছেন। এই ঐক্যমতের প্রতি নেতানিয়াহুর সমর্থন আছে ঠিক। তবে তিনি বলেন, তিনি এমন একটি কূটনৈতিক চুক্তির পক্ষে যেটা কি না, হয়েছিল ২০০৩ সালে লিবিয়ার সঙ্গে। ওই চুক্তির আওতায় পরিদর্শক দলকে পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শন এবং পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। তবে এটা পরিষ্কার নয়, ট্রাম্প ইরানের ক্ষেত্রে এমন কঠিন শর্ত আরোপ করেছেন কি না।
বিশ্লেষক নাদাভ ইয়াল বলেন, ট্রাম্পের পক্ষ থেকে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের আলোচনার বিষয়টি জানানোর অর্থ হচ্ছে দুই নেতৃত্বের মধ্যে স্বচ্ছতা দেখানো।
ট্রাম্পের ‘স্বাধীনতা দিবস’–এ বিভিন্ন দেশের পণ্যে শুল্ক আরোপের ঘোষণার আগের দিন ইসরায়েল আগেভাগে পদক্ষেপ নেয়। জানিয়ে দেয়, মার্কিন পণ্যের ওপর থেকে সব শুল্ক তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি ইসরায়েলের। বৃহৎ ব্যবসায়িক অংশীদারের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন ১৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের শুল্কের বিষয়টি পরিষ্কার করতে নেতানিয়াহুকে ওয়াশিংটনে ডাকা হয়েছে। তিনি প্রথম কোনো বিশ্বনেতা, শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। তিনিই প্রথম ট্রাম্পের মুখোমুখি হয়েছেন। অন্যান্য বিশ্বনেতা শুল্কের বিষয়টি কীভাবে দফারফা করবেন, সেটা নেতানিয়াহুর বৈঠক থেকে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বৈঠকে ট্রাম্প বারবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি ইসরায়েলের ওপর আরোপিত শুল্ক কমাবেন—এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি। প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি মতের পরিবর্তন করবেন? জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘বোধহয় না’। তিনি প্রতিবছর ইসরায়েলকে দেওয়া শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তার কথা উল্লেখ করেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ইসরায়েলকে ৪০০ কোটি ডলার দিই। ইতিমধ্যে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র থেকে যথেষ্ট পাচ্ছে।’ তিনি এ অর্জনের জন্য নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানান।
গত বছরের শেষ দিকে সিরিয়ায় বাশার আল–আসাদ সরকারের পতনের পর নিজ নিজ স্বার্থে সে দেশে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ইসরায়েল ও তুরস্ক। ইসরায়েলের আশঙ্কা, সিরিয়ার নতুন নেতৃত্ব অতীতে ইসলামপন্থী ছিল। এই নতুন নেতৃত্ব ইসরায়েল সীমান্তে নতুন করে হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে ইসরালয়েল সিরিয়ার ভূখণ্ডে বাফার জোন তৈরি করেছে। ইসরায়েল বলছে, নতুন নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা এই বাফার জোন বজায় রাখবে।
তুরস্ক আবার সিরিয়ায় নতুন খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশটির এই ভূমিকায় ইসরায়েলের নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, সিরিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে পারে তুরস্ক। নেতানিয়াহু গত মঙ্গলবার বলেছেন, সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি ‘ইসরায়েলের জন্য ভয়ংকর’ হবে।
একসময় ইসরায়েলের আঞ্চলিক অংশীদার ছিল তুরস্ক। গাজায় ইসরায়েলের হামলা ঘিরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। তখন থেকেই সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েফ এরদোয়ান গাজায় ইসরায়েলি হামলার কড়া সমালোচক। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
ক্রমাগত ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এমন একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহু ঘনিষ্ঠ মিত্রের সমর্থন আশা করেছিলেন। আশা করেছিলেন, ট্রাম্প তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দেবেন। উল্টো সিরিয়া নিয়ে এরদোয়ানের বক্তব্যের প্রশংসা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এসব দেশের মধ্যে নিজেকে সম্ভাব্য একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচনা করছেন। তিনি তুরস্কের সঙ্গে কাজ–কারবারে নেতানিয়াহুর প্রতি ‘যুক্তিসংগত’ হওয়ার আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উদি সোমার বলেন, ‘এখানে ইসরায়েলকে ব্ল্যাঙ্ক চেক (কাজ করার অসীম স্বাধীনতা) দেওয়া হয়নি। এখানে কোনো নিঃশর্ত ভালোবাসা নেই। এটি শর্তসাপেক্ষ। নির্দিষ্ট পন্থায় শর্তসাপেক্ষে এই সম্পর্ক পরিচালিত হয়।’
বৈঠককালে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা এবং গাজায়ে আটক ইসরায়েলিদের বিষয়ে কথা বলেছেন। অন্যান্য ইস্যুর আলোচনায় এই বিষয়টি কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে গাজায় বন্দীদের দুর্দশা নিয়ে এবং তাদের মুক্ত করার বিষয়ে কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি ‘শয়তান অত্যাচারী হামাসের’ অবসান নিয়েও কথা বলেন। এ সময় ট্রাম্প বন্দীদের বিষয়ে সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং গাজার ‘মালিকানা’ ও ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে সরানো নিয়ে তাঁর আরেক পরিকল্পনার কথা বলেন। ইসরায়েলের এক সময়ের প্রান্তিক এই ধারণা এখন নেতানিয়াহুসহ দেশটির মূলধারার রাজনীতিবিদদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অবশ্য এ নিয়ে মতভিন্নতা যে এখন আসন্ন, সে চিহ্ন ফুটে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।
নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গত মাসে গাজায় আবার নৃশংস আগ্রাসন শুরু করেছেন। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা পর্যন্ত হামলা চালিয়ে যেতে তাঁর সরকারের ওপর মিত্রদের চাপ রয়েছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি সহসা যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তড়িগড়ি করছেন না। এমনকি গাজায় বন্দী ইসরায়েলিদের ফিরিয়ে আনার কোনো তাগাদাও অনুভব করছেন না।
ট্রাম্প অবশ্য এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তিনি বন্দীদের মুক্ত দেখতে চান এবং গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং এ ক্ষেত্রে খুব বেশি দেরি করা যাবে না।