
বিশ্ব অর্থনীতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি মার্কিন ডলার; কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস
কৃষ্ণ কুমার শর্মা, প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:
২০২৫ সালের এপ্রিলের প্রেক্ষাপটে, মার্কিন ডলার বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেন এবং রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের ব্যাপক ও গভীর প্রভাব অন্য কোনো মুদ্রার দ্বারা এখনো চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়নি।
যদিও গত কয়েক দশকে ইউরো, জাপানি ইয়েন এবং চীনা ইউয়ান এই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা করেছে, তবুও মার্কিন ডলার তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, গভীর এবং তরল আর্থিক বাজার, তুলনামূলক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত গ্রহণযোগ্যতার কারণে এখনো বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বহাল রয়েছে।
এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব—কেন মার্কিন ডলার এখনো বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরযোগ্য মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত, এর ক্ষমতার উৎস কী, ভবিষ্যতে কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে, এবং কেন ইউয়ান বা অন্য কোনো মুদ্রা এখনও ডলারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারছে না।
ঐতিহাসিক পটভূমি: ব্রেটন উডস থেকে আজ পর্যন্ত-
মার্কিন ডলারের এই প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছানো কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন মেটাতে ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে অনুষ্ঠিত ব্রেটন উডস সম্মেলনে ৪৪টি মিত্রশক্তি একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ভিত্তিতে মার্কিন ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে নির্দিষ্ট বিনিময় হারে (প্রতি আউন্স ৩৫ ডলার) আবদ্ধ করা হয় এবং অন্য দেশগুলোর মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এই ব্যবস্থার ফলে ডলার দ্রুতই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর ওয়াশিংটনে স্থাপিত হওয়ায়, ডলার-ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি আরও মজবুত হয়।
১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নেতৃত্বে স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের বিনিময় ব্যবস্থা বাতিল হলে (Nixon Shock), অনেকেই ডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত ডলার এতটাই গভীরভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একীভূত হয়ে পড়েছিল যে, তার এই অবস্থান টিকে যায় এবং আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান-
২০২৪ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৫৯ শতাংশ মার্কিন ডলারে সংরক্ষিত রয়েছে। ইউরো, ইয়েন, পাউন্ড ও অন্যান্য মুদ্রা মিলেও এ হারকে ছুঁতে পারে না।
ডলারের এই আধিপত্যের কারণ—
• দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা,
• বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা,
• মার্কিন ট্রেজারি বিলের মতো নিরাপদ ও তরল সম্পদের প্রাচুর্য,
• এবং একটি শক্তিশালী ও স্বচ্ছ আইনি কাঠামো।
বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য-
বিশ্বের বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আজও মার্কিন ডলারে পরিচালিত হয়। অপরিশোধিত তেল, স্বর্ণ এবং অন্যান্য মৌলিক পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও লেনদেন ডলারে হয়ে থাকে। এমনকি দুইটি ভিন্ন দেশ যাদের নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে, তারাও প্রায়শই ডলারে লেনদেন করে।
ডলারের এই ব্যাপক ব্যবহার “পেট্রোডলার” ধারণাকে জন্ম দিয়েছে। শিপিং, বীমা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সেবার ক্ষেত্রেও ডলার ব্যবহার একটি প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা রাতারাতি পরিবর্তন করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে ডলারের প্রভাব-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির একটি, যার আর্থিক বাজার অত্যন্ত গভীর ও তরল। বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা মার্কিন বন্ড, স্টক এবং অন্যান্য আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
এর কারণ:
• রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা,
• শক্তিশালী আইনি কাঠামো,
• উন্নত কর্পোরেট গভর্ন্যান্স,
• এবং নিরাপদ সম্পদে প্রবেশাধিকার।
এইসব কারণে ডলারে বিনিয়োগ লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্ত বলে বিবেচিত হয়।
বিকল্প মুদ্রার চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
চীনের ইউয়ান, ইউরোসহ অন্যান্য প্রধান মুদ্রা মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানালেও, বাস্তবে তারা এখনো আঞ্চলিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। ইউয়ানের ক্ষেত্রে:
• আর্থিক বাজারের স্বচ্ছতার অভাব,
• চীনের রাজনৈতিক অস্থিরতা,
• এবং নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হারসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
ডলারের মতো বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে ইউয়ান বা ইউরোর সামনে এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
বিশ্ব অর্থনীতির জটিল ও বহুমাত্রিক কাঠামোয় মার্কিন ডলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার উপর গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রিজার্ভ ব্যবস্থার ভিত্তি। বর্তমানে কোনো মুদ্রাই ডলারের জায়গা নেওয়ার মতো শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি।
অতএব, অন্তত আগামী কয়েক দশকে মার্কিন ডলারের আধিপত্য অটুট থাকবে বলেই মনে হয়।
কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস
প্রজ্ঞা নিউজ, নিউ ইয়র্ক, ইউএসএ