তথাকথিত সংস্কারের নামে কী চলছে বাংলাদেশে?
নয়ন বিশ্বাস রকি, প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক :
বাংলাদেশ, যে দেশটি ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, আজ তা গভীর সংকটের মুখোমুখি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা—সবকিছুই এক অজানা অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কথিত সংস্কারের নামে দেশে চলছে দমন-পীড়ন, আইনের শাসন দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে, ইতিহাসের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে, এবং সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এক ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতা কমে গেছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ জনগণ দিশেহারা। স্বাধীন গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা আজ শৃঙ্খলিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন, বিরোধী মতাবলম্বীদের দমন-পীড়ন করা হচ্ছে, এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ।
সংস্কারের নামে দমন-পীড়ন ও ইতিহাস বিকৃতি-
দেশের তথাকথিত সংস্কারের নামে চলছে এক ধরনের স্বৈরশাসন। ইতিহাস বিকৃত করে জাতির মূল পরিচয় পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির অবকাঠামো পরিবর্তন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে গোপন করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
স্বাধীনতার মূল চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধ্বংস করতে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তও আলোচনায় এসেছে। সংবিধানের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে দেশ একনায়কতন্ত্রের শাসনে প্রবেশ করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণমাধ্যমের সংকট-
গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এ দুটি বিষয়ই চরম হুমকির মুখে। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সত্য প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাংবাদিকদের উপর মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানি চালানো হচ্ছে, যাতে তারা সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে।
এছাড়া, মিডিয়া হাউসগুলো দখল করে, স্বাধীন সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, এবং বিরোধী মতামত দমন করে বাকস্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এক ভয়াবহ দমন-পীড়নের মধ্যে রয়েছে দেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
ধর্মীয় ও সামাজিক সহিংসতা-
বাংলাদেশ, যা একসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ তা চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, মন্দির, গীর্জা ও মাজারে হামলা চালানো হচ্ছে। সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হানা হচ্ছে, যা দেশের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
নারীদের অধিকার এবং নিরাপত্তা এখন চরম হুমকির সম্মুখীন। ধর্ষণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গৃহবন্দিত্ব এবং কর্মস্থলে নারীদের প্রতি বৈষম্যের ঘটনা বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
আইনের শাসন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-০
আইনের শাসন একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। কিন্তু বাংলাদেশে আজ আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের দমন করার চেষ্টা চলছে। বহু নিরপরাধ মানুষকে বিনা বিচারে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে।
বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়ায় জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে, যা ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাকে ধ্বংস করছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান, শিক্ষকদের লাঞ্ছনা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা আজ চরমে পৌঁছেছে।
অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্নীতির মহোৎসব-
অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ। বাংলাদেশ আজ দুর্নীতির এক মহোৎসবের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। সরকারি অর্থ তছরুপ, চাঁদাবাজি, লুটপাট এবং বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। তরুণ সমাজ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। অপরদিকে, কালো টাকার মালিকরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে চরম সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
দেশজুড়ে অপরাধের উল্লাস-
দেশজুড়ে চলছে অপরাধের উল্লাস। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। মা-বাবার সামনে সন্তানের হত্যাকাণ্ড, প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক অপরাধ বেড়ে চলেছে।
শত শত মায়ের বুক খালি হয়ে যাচ্ছে। অলিগলি, নদী, পুকুর, মাঠে প্রতিদিন লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সরকারের ব্যর্থতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
কোন পথে বাংলাদেশ ?
বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সংস্কারের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, ন্যায়বিচারের নামে অন্যায় হচ্ছে, উন্নয়নের নামে চলছে দুর্নীতি ও লুটপাট।
দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের এখন দায়িত্ব—সচেতন হওয়া, সত্যকে সামনে আনা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। একটি স্বাধীন ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে হলে জনগণকে একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে। আজ সেই চেতনাকে পুনরুদ্ধার করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের ঐক্য, সাহসিকতা ও সঠিক নেতৃত্বই পারে বাংলাদেশকে এই সংকট থেকে মুক্ত করতে।