
“দোল পূর্ণিমা: ঐতিহ্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে রঙের উৎসব”
- By N/A --
- 14 March, 2025
এই প্রতিবেদনে দোল পূর্ণিমা হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব, যা ভালোবাসা, আনন্দ ও সম্প্রীতির বার্তা বহন করে। সকালে পূজার আয়োজনের পর শুরু হয় রঙের খেলা। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই আবির ও গুলালে একে অপরকে রাঙিয়ে তোলে। পরিবারের সদস্যরা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে, এবং বন্ধুরা দোলের আনন্দে মেতে ওঠে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি গান, নাচ ও মিষ্টিমুখ হয়। রাস্তা ও মন্দির প্রাঙ্গণ রঙিন আবিরে ঢেকে যায়, সৃষ্টি হয় এক প্রাণবন্ত পরিবেশ। এই দিনে সমাজের সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই মিলেমিশে উৎসব উদযাপন করে।
দোল উৎসব শুধু রঙের নয়, এটি হৃদয়ের বন্ধন দৃঢ় করারও প্রতীক। বর্তমান সময়ে এই উৎসব শুধু ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং সার্বজনীন আনন্দ উৎসবে রূপ নিয়েছে। তা নিয়ে লিখেছেন- কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস
দোল পূর্ণিমা, রঙের উৎসব, কেবল একটি আনন্দময় উদযাপন নয়; এটি এক প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন। এই উৎসবের মূল নিহিত রয়েছে বৈদিক যুগে, যেখানে প্রকৃতির পরিবর্তন এবং আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালিত হতো। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত এই উৎসব শীতের শুষ্কতা কাটিয়ে বসন্তের প্রাণবন্ত আগমনের বার্তা বহন করে।
এই উৎসবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট গভীরভাবে বৈদিক যুগের সাথে সংযুক্ত, যেখানে অগ্নি এবং সোম (চন্দ্র) বিশেষ গুরুত্ব পেত। ফাল্গুন পূর্ণিমার রাতে, যখন চন্দ্র পূর্ণরূপে উদিত হয়, তখন অগ্নিকে আহুতি দেওয়ার প্রথা ছিল। এই অগ্নি আহুতি অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করত। "ওঁ অগ্নিং দূতম্ বৃণীমহে হোতারং বিশ্ববেদসম্। অস্য যজ্ঞস্য সুক্রতুম্।" এই মন্ত্রের মাধ্যমে, অগ্নিকে আহ্বান করা হতো, যাতে তিনি সমস্ত নেতিবাচকতাকে পুড়িয়ে শুদ্ধ করেন। হোলিকা দহনের প্রথা, যা দোল পূর্ণিমার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সম্ভবত এই বৈদিক অগ্নি আরাধনারই একটি পরিবর্তিত রূপ।
দোল পূর্ণিমার সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনী হল প্রহ্লাদ ও হোলিকার গল্প। হিরণ্যকশিপু, এক অত্যাচারী রাজা, নিজেকে ঈশ্বর মনে করত এবং তার পুত্র প্রহ্লাদকে বিষ্ণুর উপাসনা করতে নিষেধ করত। কিন্তু প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার সাহায্যে প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে। হোলিকার গায়ে এমন একটি চাদর ছিল যা তাকে আগুন থেকে রক্ষা করত। কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায়, প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন এবং হোলিকা আগুনে পুড়ে মারা যায়। "ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।" এই মন্ত্রের মাধ্যমে, ভগবান বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশ করা হয়। এই কাহিনী অশুভের ওপর শুভের জয় এবং ভক্তির শক্তির প্রতীক। হোলিকা দহন এই ঘটনার স্মরণে পালিত হয়।
দোল পূর্ণিমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা। বৃন্দাবনে, কৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতে উঠতেন। এই লীলা প্রেমের পবিত্রতা এবং মিলনের আনন্দের প্রতীক। "রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা, দোল পূর্ণিমার মূল বাণী, রঙের খেলায় মিশে যাক, সকল মনের গ্লানি।" এই শ্লোকের মাধ্যমে, দোল পূর্ণিমার মূল বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে। এই রঙ খেলা সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একসূত্রে বাঁধে। এই দিনে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক হয়ে আনন্দে মেতে ওঠে।
দোল পূর্ণিমার প্রধান আচার হল হোলিকা দহন এবং রঙ খেলা। ফাল্গুন পূর্ণিমার আগের রাতে, কাঠ, শুকনো পাতা এবং ঘাস দিয়ে একটি উঁচু স্তূপ তৈরি করা হয়। তারপর, এই স্তূপে হোলিকার একটি মূর্তি স্থাপন করে আগুন জ্বালানো হয়। এই আগুন অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক। পূর্ণিমার দিন, মানুষ একে অপরের গায়ে আবির, গুলাল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক রঙ মাখিয়ে আনন্দ করে।
এই উৎসব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে স্মরণ করি এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিই। আধুনিক সময়ে, দোল পূর্ণিমার উদযাপন কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। এখন অনেকেই ডিজে পার্টি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এই দিনটি পালন করে। তবে, এখনও ঐতিহ্যবাহী উপায়ে দোল পূর্ণিমা পালনের প্রচলন রয়েছে। "ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।" এই মন্ত্রের মাধ্যমে, সকলের জন্য শান্তি কামনা করা হয়। দোল পূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য হল ভালোবাসা, আনন্দ এবং সম্প্রীতি। আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে এই উৎসবকে উদযাপন করি এবং আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলি।
"রঙের উৎসবে প্রাণ ভরে উঠুক আনন্দে, শুভ দোল পূর্ণিমার, এই শুভ সন্ধে।" এই শ্লোকের মাধ্যমে, দোল পূর্ণিমার শুভ কামনা করা হয়েছে। এই দোল পূর্ণিমায়, আপনার জীবন ভরে উঠুক রঙে, আনন্দে এবং ভালোবাসায়। শুভ দোল পূর্ণিমা!
দোল পূর্ণিমা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে এবং বিভিন্ন রীতিতে পালিত হয়। বাংলায় এটি দোলযাত্রা নামে পরিচিত। এখানে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি দোলায় স্থাপন করে শোভাযাত্রা বের করা হয়। উত্তর ভারতে এটি হোলি নামে পরিচিত। এখানে হোলিকা দহনের পরদিন রঙ খেলা হয়। দক্ষিণ ভারতে এটি কামদহন নামে পরিচিত। এখানে কামদেবের মূর্তি পুড়িয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ করা হয়। ওড়িশায় এই উৎসবটি দোলযাত্রা বা মেলন নামে পরিচিত। এখানে জগন্নাথ দেবের বিশেষ পূজা করা হয়।
দোল পূর্ণিমা সামাজিক সম্প্রীতি ও একাত্মতার প্রতীক। এই উৎসবের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষ এক হয়ে আনন্দ উদযাপন করে। এই দিনটি ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একসূত্রে বাঁধে। দোল পূর্ণিমা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির উৎসব। এই দিনটি অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করে। রঙ খেলার মাধ্যমে মানুষ মনের মলিনতা দূর করে পবিত্রতা অর্জন করে।
দোল পূর্ণিমা উৎসবের কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাব পড়ে। রঙ, আবির, মিষ্টি, পোশাক এবং অন্যান্য সামগ্রীর বিক্রি বৃদ্ধি পায়। এই উৎসবের কারণে পর্যটন শিল্পেও গতি আসে। আধুনিক সময়ে, রাসায়নিক রঙের ব্যবহার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই, প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়াও, হোলিকা দহনের জন্য অতিরিক্ত কাঠ ব্যবহার করা উচিত নয়।
দোল পূর্ণিমা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক। এই উৎসবকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর তাৎপর্য বজায় রাখতে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। দোল পূর্ণিমার বিশেষ কিছু গান রয়েছে। "আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে", "ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল", "ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান" এই গানগুলো এই উৎসবের আনন্দ কে আরও বাড়িয়ে তোলে।
দোল পূর্ণিমার দিনে বিশেষ কিছু খাবার তৈরি করা হয়। মালপোয়া, গুজিয়া, ঠান্ডাই এই খাবারগুলো এই উৎসবের আনন্দ কে আরও বাড়িয়ে তোলে। দোল পূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি আমাদের জীবনের একটি অংশ। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য হল ভালোবাসা, আনন্দ এবং সম্প্রীতি। আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে এই উৎসবকে উদযাপন করি এবং আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলি।
"রঙের উৎসবে প্রাণ ভরে উঠুক আনন্দে, শুভ দোল পূর্ণিমার, এই শুভ সন্ধে।" এই শ্লোকের মাধ্যমে, দোল পূর্ণিমার শুভ কামনা করা হয়েছে। এই দোল পূর্ণিমায়, আপনার জীবন ভরে উঠুক রঙে, আনন্দে এবং ভালোবাসায়। শুভ দোল পূর্ণিমা!
সকালের প্রথম রোদের আলো পড়তেই ঘরভর্তি উচ্ছ্বাস। আজ দোল! চারপাশে রঙের গন্ধ, আবিরের ধুলো, আর আনন্দের এক অন্য রকম পরিবেশ। ছোট্ট মন আজ একটাই চিন্তা নিয়ে জেগে উঠেছে— কখন বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে রঙ খেলতে যাবে!
মায়ের গলা শোনা গেল, "এই যে আমাদের ছোট্ট রঙপরী, ঘুম থেকে উঠেই রঙের অপেক্ষা?"
হাসিমুখে বলা হলো, "মা, আমার আবির কোথায়?"
মা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললেন, "তোর জন্য তো লাল, হলুদ আর নীল রাখা হয়েছে!"
খুশিতে মন নেচে উঠল। আজ সবার আগে রঙ লাগাতে হবে! কিন্তু একটা কথা মনে পড়ল— প্রতিবারই কেউ না কেউ আগে এসে গালে আবির মেখে দেয়! এবার কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হবে।
বাড়ির উঠোনে বড়দের রঙ খেলা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কারও গায়ে আবির মাখিয়ে দিচ্ছে, কেউ একে অপরকে রঙে ভরিয়ে হাসিতে মেতে উঠছে। বাবা এসে কপালে একটু হলুদের ছোঁয়া দিয়ে বললেন, "শুভ দোল পূর্ণিমা, মা!"
হাসি ফুটে উঠল মুখে, সঙ্গে একটাই অনুরোধ— "কিন্তু বাবা, তুমি কালো রঙ লাগাবে না!"
বাবা হেসে বললেন, "আবিরের রঙ তো ভালোবাসার রঙ, সেটা কালো হয় নাকি?"
দৌড়ে বাইরে যাওয়া হলো বন্ধুদের খুঁজতে। পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে কেউ যেন চুপচাপ অপেক্ষা করছে, চোখে এক দুষ্টু হাসি! নিশ্চয়ই আবার চমকে দেওয়ার ছক কষছে।
"এই দাঁড়া! আজ আগে আমি রঙ দেব!"
"দেখা যাক!"
কিছুক্ষণ ছুটোছুটি, হাসাহাসি, আর দুষ্টুমি চলতেই হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক মুঠো লাল আবির গালে ছুঁইয়ে দেওয়া হলো।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল মন— "তুই আবার আগে লাগালি!"
হাসিমুখে উত্তর এলো, "তুই তো আমার সব সময়ের প্রথম বন্ধু, তাই তোকে প্রথম রঙ দিতে হবে!"
গম্ভীর মুখ করে থাকা হলেও, এক মুহূর্তের মধ্যেই এক মুঠো হলুদ রঙ ছুঁড়ে দেওয়া হলো।
"এই যে! এবার তুই আমার প্রথম রঙ!"
হাসির রোল পড়ে গেল। চারপাশের কোলাহল, রঙিন বাতাস, আর বন্ধুত্বের ছোঁয়ায় তৈরি হলো এক মিষ্টি মুহূর্ত— যা সারাজীবন রয়ে যাবে এক রঙিন স্মৃতি হয়ে।
শুভ দোল! রঙে ভরে থাকুক জীবন!
লেখক: কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস
কলামনিস্ট, প্রজ্ঞা নিউজ,
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র