Logo

আন্তর্জাতিক    >>   ভূরাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বনাম বাংলাদেশের অর্থনীতি

ভূরাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বনাম বাংলাদেশের অর্থনীতি

ভূরাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বনাম বাংলাদেশের অর্থনীতি

কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস


প্রাচীন গ্রীসের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং আধুনিক বিশ্বে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যে তুলনা করা হয়েছে, তা সত্যিই চমকপ্রদ। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে আজকের বিশ্ব পর্যন্ত, রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও পতনের একটি অনবদ্য কাহিনী তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন স্পার্টা এবং এথেন্সের মধ্যে অলিগার্কি এবং গণতন্ত্রের পার্থক্য ছিল, তেমনি অন্যদিকে, বর্তমান সময়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যা এক গোপন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই দুই যুগের মধ্যে সম্পর্ক এবং ঘাত-প্রতিঘাতের ঘটনা অনেকটাই একরকম।

প্রাচীন গ্রীসে স্পার্টা ছিল এক শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র, যেখানে অলিগার্কি শাসনব্যবস্থা চলত। এটি ছিল ঐতিহ্য ও সামরিক শক্তির প্রতি গুরুত্ব দেয়া একটি সমাজ। এখানে, যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং সমাজের একটি ছোট, শক্তিশালী শ্রেণির শাসন ছিল প্রধান। অন্যদিকে, এথেন্স ছিল গণতন্ত্র ও সংস্কৃতির কেন্দ্র, যা নতুন চিন্তা, জ্ঞান ও শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত ছিল। তবে, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ সত্ত্বেও তাদের মধ্যে শক্তির পার্থক্য ছিল এবং একসময় তারা যুদ্ধসংঘটিত হয়, যা ছিল ‘পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ’। যুদ্ধের মূল কারণ ছিল স্পার্টার ভয়, যে যদি এথেন্স তাদের সামরিক শক্তির চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। থুসিডাইডিস এই যুদ্ধের বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, “যখন কোনও রাষ্ট্র উঠে আসে, তখন প্রতিষ্ঠিত শক্তি তার বিরুদ্ধে আতঙ্কিত হয়ে যুদ্ধের পথে চলে আসে।” এই ঘটনা আজকের বিশ্বে বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেকটা স্পার্টা এবং এথেন্সের যুদ্ধের মতো। যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি, এবং চীন একটি উঠতি শক্তি। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “চীন ঘুমাচ্ছে, তাকে ঘুমাতে দাও। যদি এই ঘুম ভাঙে, সে পুরো পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিবে।” আজকের দিনে চীনের বিস্ময়কর উত্থান সেই ঘুমন্ত দানবের মতো, যা এখন বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শক্তিশালী প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, চীনের এই দ্রুত উত্থান তার নিজের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখার প্রয়াসে লিপ্ত।

বিশ্ব রাজনীতির প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে আজকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে তাকালে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এখনও তার নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক শক্তি, কূটনৈতিক কৌশল এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে, চীন ও রাশিয়ার উত্থানের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার নেতৃত্বের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক শক্তি, সামরিক আধিপত্য এবং কৌশলগত জোট গঠনের মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাপী ডলার আধিপত্য, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর বিস্তার এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করায় যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে আছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পরও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রতিক কালে, চিপ প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পোশাক শিল্প, রেমিট্যান্স, কৃষি এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত করেছে। তবে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও ভারতের মধ্যকার প্রতিযোগিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক কৌশলের ফলে বাংলাদেশকে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া আবশ্যক। আধুনিক প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে তার অবস্থান আরও দৃঢ় করতে হবে। বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র যদি এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়, তবে বিশ্বে গণতন্ত্র ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির আধিপত্য বজায় থাকবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান রপ্তানি গন্তব্য, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে। জিএসপি সুবিধা বাতিলের পরও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক শক্তিশালী রয়েছে। তবে, বাণিজ্যিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র নানা শর্ত আরোপ করে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং বিনিয়োগ প্রকল্পে ব্যাপক অর্থায়ন করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশকে অবশ্যই তার শ্রমশক্তির উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সহায়ক হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা পাবে, যা ভবিষ্যতের শিল্পায়নে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশ যদি তার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সুসংহত হবে। এ কারণে বাংলাদেশকে অবশ্যই নীতিনির্ধারণে কৌশলী হতে হবে এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের জয়ই হবে বিশ্ব স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। যুক্তরাষ্ট্র যদি নেতৃত্ব ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে বিশ্বের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যা বাংলাদেশসহ অনেক উদীয়মান অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় শুধু একটিদেশের সাফল্য নয়, বরং এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার প্রতীক।

লেখক:

কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস, কলামিস্ট