Logo

অর্থনীতি    >>   ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ; বিপদের মুখে ২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ; বিপদের মুখে ২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ; বিপদের মুখে ২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ

Progga News Desk:

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘটনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পরতে শুরু করছে। যার প্রভাব ক্রীড়াজগতেও লক্ষ করা যাচ্ছে। খেলাধুলার দুনিয়ায় আয়োজনের ব্যাপকতা, অর্থের সমাগম ও বিশ্বজুড়ে সম্পৃক্ততা বিচারে সবচেয়ে বড় দুটি ইভেন্ট ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক। এ দুটি ইভেন্টেরই পরবর্তী আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া গোটা বিশ্বে খেলাধুলা পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজারও যুক্তরাষ্ট্র।

এমন প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের কারণে খেলাধুলায় স্পন্সরদের অর্থের জোগান, ক্রীড়া স্থাপনা ও ব্র্যান্ড এবং ক্রীড়াপণ্য প্রস্তুত ও দামে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে স্টক মার্কেটে থাকা ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে দরপতনও ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প  ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর প্রথমেই বড় ধাক্কা লাগে স্টক মার্কেটে। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্রীড়াসামগ্রী বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান আন্ডারআর্মারের শেয়ারের ১৮.২৫ শতাংশ দরপতন ঘটেছে, যা নাইকির বেলায় ১৪.৪%, পুমার ১১.৮% এবং অ্যাডিডাসের ১১.৭%।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০২৪ সালে ১০৩০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ক্রীড়াপণ্য আমদানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যার ৬২৭ কোটিরই রপ্তানিকারক চীন। বিশ্ববাজারের বেশির ভাগ ক্রীড়াপণ্যই নির্মিত হয় চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়াসহ এশিয়ার দেশগুলোতে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন, এতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী দেশ এশিয়ারই। কম্বোডিয়ার জন্য ৪৯%, ভিয়েতনামের ৪৬%, চীনের ৩৪% এবং ইন্দোনেশিয়ার জন্য ৩২% পাল্টা শুল্ক আরোপ হয়েছে। এসব দেশে তৈরি হয় খেলারসহ সব ধরনের ফুটওয়্যার, সাঁতারের পোশাক, ট্র্যাকশুট, আর্টিকলস, বল, গলফ, রেকেটসহ অন্যান্য সামগ্রী।

যুক্তরাষ্ট্র যেসব চিন্তা থেকে শুল্ক আরোপ করেছে, তার একটি হচ্ছে আমদানি কমিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করা। তবে ক্রীড়াপণ্যের বেলায় এই বিবেচনা কাজে লাগবে না বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের অর্থনীতির প্রভাষক ভেরা ইউয়েন উইং-হান। সাউথ মর্নিং চায়না পোস্টকে তিনি বলেন, এ ধরনের পণ্য আমেরিকায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা খুবই ব্যয়বহুল হবে। আমদানি তাদের করতেই হবে, দাম বেশি হলেও।

তবে চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের শেনজেন ফিন্যান্স ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ সিমন লি সিইউ-পোর ধারণা, শুল্কের কারণে প্রস্তুতকারকদেরও ভুগতে হবে, ‘যে খরচ বাড়বে, সেটা পুরোটা হয়তো ভোক্তাকে দিতে হবে না। কিছু খুচরা বিক্রেতাকে বহন করতে হবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে লাভের পরিমাণ কমে আসছে, পণ্যের চাহিদাও কমছে।

ক্রীড়াপণ্য প্রস্তুতকারকের বাইরে আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বড় টুর্নামেন্টের স্পন্সরে। ২০২৬ সালে কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে যৌথভাবে ৪৮ দলের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র। আর দুই শ–এর বেশি দেশ ও অঞ্চলের অংশগ্রহণে ২০২৮ অলিম্পিক হবে লস অ্যাঞ্জেলেসে।

বিশ্বের বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের আয়োজনে স্পন্সর হিসেবে অংশ নেয়। আর বিশ্বকাপের মতো বড় আয়োজন যখন যুক্তরাষ্ট্রে, তখন দেশটির বাজারে নিজেদের প্রচার-প্রসারে আগ্রহ থাকে অনেকেরই।

কিন্তু ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নীতির পর সেটা কমে যেতে পারে বলে মনে করেন স্পোর্টস ইভেন্ট কৌশলবিদ জন জেরাফ।

ট্রাম্পের কঠোর বাণিজ্যনীতি ও উচ্চ শুল্কহার দেখে অনেক স্পন্সর এখন তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করছে।এসব নিয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যম বিবিসিকে বলেন, যদি কোনো স্পনসর আমেরিকায় বিক্রিই করতে না পারে, তাহলে কোটি কোটি পাউন্ড ব্যয় করবে কেন?

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাই গ্রুপ। ট্রাম্প চান, যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থেকে গাড়ি না আনতে, বরং তাঁর দেশের গাড়িই অন্যরা কিনুক।

এখন শুল্ক আরোপের ঘটনায় হুন্দাই বিশ্বকাপে বড় আকারে সম্পৃক্ত হওয়ার চিন্তা না–ও করতে পারে। সৌদি আরবের আরামকো, কাতারের কাতার এয়ারওয়ে, চীনের লেনোভোর মতো প্রতিষ্ঠানও হাঁটতে পারে একই পথে।

এ বিষয়ে ইউরোপিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোভাব জানতে বিবিসি যোগাযোগ করেছিল দ্য ইউরোপিয়ান স্পনসরশিপ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। আপাতত ‘গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে’র কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটে দরপতনের ঘটনায় শঙ্কায় আছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে সফল ফুটবল ক্লাবটি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত।

ট্রাম্পের শুল্কারোপের ঘটনা দলটিকে কীভাবে ভোগাতে পারে জানিয়ে ফুটবল-অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ কেইরান ম্যাগুয়ার বিবিসিকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ইউনাইটেডের ৬৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কারণে ডলারের মান বেড়ে গেলে এই ঋণের পাউন্ডে রূপান্তরিত মূল্যও বেড়ে যাবে, যা ক্লাবের হিসাব ও লাভ-ক্ষতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।ম্যাগুয়ার জানান, ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, শুধু মুদ্রার বিনিময় হারের তারতম্যের কারণে ইউনাইটেডকে ৫.৮০ কোটি পাউন্ড অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছিল।

তবে ইউনাইটেডের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে টুর্নামেন্ট হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপই। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডা যখন যৌথভাবে ২০২৬ বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পেয়েছিল, ইউএস সকার ফেডারেশনের সভাপতি কার্লোস কোরদেইরো সেটিকে ‘তিন দেশের একতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে বিশ্বকাপকেন্দ্রিক সেই ঐক্য এখন অতটা মজবুত নেই।

জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসেই কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এ নিয়ে দেশ দুটি প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর গত মাসে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্তেজনা আসন্ন টুর্নামেন্টকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলবে, ‘আমি মনে করি, এটা টুর্নামেন্টকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলবে। উত্তেজনা ভালো জিনিস।’ এরই মধ্যে ট্রাম্প কানাডাকে ‘৫১তম রাজ্য’ বানানোর কথা বলায় যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ ও এনএইচএল দলের খেলার সময় কানাডীয় দর্শক কর্তৃক মার্কিন জাতীয় সংগীতকে বিদ্রুপের ঘটনাও ঘটেছে।

অর্ধশতাধিক দেশের দল এবং তিন গুণের বেশি দেশের দর্শক নিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনে তিন দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা, দর্শকের ভিসাপ্রাপ্তি ও সীমান্ত অতিক্রমের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে ট্রাম্পের অননুমেয় ও প্রচলিত ধারার বাইরে কাজ করার প্রবণতা গোটা বিশ্বকাপ আয়োজনের মসৃণতাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেওয়ার শঙ্কা আছে যথেষ্টই।

তবে ভালো দিক হচ্ছে, ২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনে হোয়াইট হাউজ টাস্কফোর্সের প্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। শুল্ক আরোপ-সৃষ্ট অস্থিরতা এর জেরে তৈরি হওয়া নেতিবাচক প্রভাব কমানোর প্রধান দায় ও দায়িত্বও তাঁরই। সূত্র: বিবিসি