Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   ১৯৭১-এর ট্র্যাজেডি: সংগীতের অন্তরালে এক পিতার আর্তনাদ

১৯৭১-এর ট্র্যাজেডি: সংগীতের অন্তরালে এক পিতার আর্তনাদ

১৯৭১-এর ট্র্যাজেডি: সংগীতের অন্তরালে এক পিতার আর্তনাদ

Progga News Desk:

ঢাকা, ১৯৭১ –এক যুদ্ধে তাঁর সুরের ঘর ভেঙে গিয়েছিল। বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীতের পথিকৃৎ, পণ্ডিত বারীণ মজুমদার তাঁর জীবনের সবচেয়ে আপন সুরটিকে হারিয়ে ফেলেন – তাঁর ছোট্ট মেয়ে, মধুমিতা মজুমদার, আদরের “মিতু”।

 

বারীণ মজুমদারের বৃত্তান্ত

পণ্ডিত বারীণ মজুমদার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণকারী, আগ্রা ও রঙ্গিলা ঘরানার উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি শুধু একজন সংগীতজ্ঞ নন; ছিলেন একজন গবেষক, শিক্ষক এবং সংস্কৃতিচিন্তক।

তার সংগীতযাত্রা শুরু হয় এক সংগ্রামের পথে। ১৯৫২ সালে পরিবারের সমস্ত বসতভিটা ও পৈতৃক সম্পত্তি সরকারি অধিগ্রহণে হারিয়ে যাওয়ার পর, বাধ্য হয়ে তিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকায় এসেবুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে উচ্চাঙ্গসংগীতের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। তিনি ঢাকা বোর্ডের সংগীত সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং বাংলাদেশ বেতারে রাগ সংগীত পরিবেশনের সূচনা করেন, যাতে সংগীতের মানোন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন।

১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর, হাতে মাত্র ৮৭ টাকা, ১৬ জন শিক্ষক ও ১১ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে তিনি “College of Music” প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি “মণিহার সংগীত একাডেমী” নামে একের পর এক সংগীতকেন্দ্র স্থাপন করেন, যেন সংগীত হয়ে ওঠে দেশের আত্মার অভ্যন্তরীন ভাষা।

 

যুদ্ধের ছায়া ও ব্যক্তিগত ক্ষতি

কিন্তু এই গৌরবময় জীবনের মাঝে ছিল এক অনির্বচনীয় ব্যথা। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, ঢাকার পরিস্থিতি দুর্ব্যবহারে রূপান্তরিত হওয়ার পর, বারীণ মজুমদারের স্ত্রী ইলা ও তিন সন্তান – পার্থ, বাপ্পা এবং মিতু – জিঞ্জিরার শুভাঢ্যা গ্রামে আশ্রয় নেন।

২ এপ্রিল, সকাল সাতটায় বুড়িগঙ্গা নদীর কাছে গানবোট থেকে শুরু হয় নির্বিচারগুলির বৃষ্টি। সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে ছোট্ট মধুমিতা, যার মাত্র দশটি ছোট পা ছিল, ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে যায়। তাঁর হারিয়ে যাওয়া সন্তান, মিতু – শ্যামলা রঙের, পাতলা গড়নের, সদা চঞ্চল ও হাসিখুশী – ছিলেন বাবার সংগীতে বাঁধা এক কিশোরী আত্মা, যার মুখে ছিল অদ্ভুত মুগ্ধতার ছোঁয়া।

মাতাপিতার চেষ্টা ছিল মিতুকে যুদ্ধের গোলযোগ থেকে রক্ষা করার জন্য তাকে অন্য নামে – ফরিদা – পরিচয় দেওয়ার। তবে, নাম পরিবর্তনেও মিতুর জীবন রক্ষা সম্ভব হয়নি।

 

হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় পিতা-সঙ্গীতজ্ঞের আর্তনাদ

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি হৃদয়বিদারক আবেদনে লেখা ছিল:

“গত ২রা এপ্রিল, সকাল সাতটায় মধুমিতা মজুমদার (মিতু) পাকসেনাদের বর্বর আক্রমণের সময় জিঞ্জিরার শুভাঢ্যা গ্রাম থেকে পালানোর সময় নিখোঁজ হয়েছে… যদি কেউ তাকে খুঁজে পান, অনুগ্রহ করে এই ঠিকানায় জানান…”

Madhumita Majumdar Mitu

                                            Madhumita Majumdar "Mitu"

এই আবেদন ছিল এক পিতার কণ্ঠহীন আর্তনাদ, একসাধকের নিরব কান্না – যিনি সংগীতের প্রতিটি তানে নিজের আত্মাকে উৎসর্গ করেছিলেন, কিন্তু মেয়ের কান্না তিনি কখনও শুনতে পাননি। বারীণ মজুমদার পরে ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামপর্যন্ত নানা জায়গায় মিতুর সন্ধানে খোঁজ চালান, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন ও প্রশাসনের সাহায্য চেয়ে উঠেন, কিন্তু ছোট্ট মিতু আর ফেরেননি।

স্বাধীনতার পরে দেশ বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠলেও, পণ্ডিতের বাড়ি যেন এক অন্য যুদ্ধের ময়দান হয়ে রয়ে যায়। প্রতিবেশীরা যখন আতশবাজি ফোটায়, তখন তাঁর সংসারে কোনো আলো জ্বলে না। বাপ্পা মজুমদার বলেন, “বাবা তখন সংগীতে ফিরে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রতিটি তান যেন দিদির খোঁজেই উঠে আসত – এক অজানা অনুপস্থিতির ব্যাকুলতা নিয়ে।”

 

সুরে সুরে জন্ম নেয় ‘রাগমধুমিতা’

মিতুর না-ফেরার পরে, বারীণ মজুমদার একাধিক রাগ রচনা করেন যা ছিল সম্পূর্ণ নতুন, আবেগতালিত ও অন্তর্মুখী। সংগীতবিদেরা বলেন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তাঁর সৃষ্ট কিছু রাগে ছিল অদ্ভুত এক হাহাকার ও মেলোডির সংমিশ্রণ, যা বাংলার সংগীত ইতিহাসে বিরল। কেউ কেউ মনে করেন, এই রাগগুলো ছিল এক বাবার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি – “রাগমধুমিতা”।

অনেকে আজ প্রশ্ন তোলেন – যদি মিতু সেদিন বেঁচে থাকত, তবে কি সে নিজের মধ্যে সেই সুরের মহিমা অনুভব করতে পারত? যুদ্ধের গোলযোগে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের অনেকেই চিরতরে তাদের জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হয়তো, অন্য কোন পরিচয়ে, অন্য ধর্মে কেউ তাকে বড় করেছিল; তবুও, কি মিতুর হৃদয়বাজে বাবার গাওয়া সেই প্রার্থনা:

“শুধু তোমারই সুরে বাঁধা, এই জীবনটা…”

বাংলাদেশের ইতিহাসে হাজারো নিখোঁজ শিশুর মধ্যে মধুমিতা একটি চিরন্তন প্রতীক। সরকার ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ – জাতীয় সংগীত যোদ্ধাদের তালিকায় এমন হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য একটি স্মারক নির্মাণ করা হোক। এটি কেবল মিতুর জন্য নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া সমস্ত সন্তানের জন্য একটি নীরব শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে থাকবে।

অবিরাম অপেক্ষা ও জাতির কষ্টের কাব্য

পণ্ডিত বারীণ মজুমদার তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতেন। কারো সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা পায়ের শব্দে তিনি চমকে উঠতেন; রাস্তায় কোনো মেয়ের গলায় মধুর সুর শোনার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতেন। হয়তো, কোনোদিন সে ফিরবে – এই আশায় তিনি সংগীতের দরজা কখনও বন্ধ করেননি। তাঁর সেই পিতা-মনের প্রতিচ্ছবি আজও বেঁচে আছে তাঁর রচনায়, তাঁর রাগে ও তাঁর নীরব প্রতীক্ষায়।

আজও, মিতু ফেরেনি ঘরে… ১৯৭১-এর সেই বিভীষিকাময় সময়ে, হাজারো বাবা-মায়ের মতো পণ্ডিত বারীণ মজুমদারও হারিয়েছিলেন স্নেহের সন্তানকে। যুদ্ধশেষ হলেও, সেই শোক ও ব্যথা কখনও মুছে যায়নি।

একজন সংগীতজ্ঞ হয়তো হাজারো শ্রোতাকে সুরে ভাসাতে পারেন, কিন্তু এক কন্যার মুখ হারিয়ে গেলে – বাজে কেবল নীরবতা।

এই গল্প শুধুমাত্র একটি পরিবারের নয়; এটি একটি জাতির ইতিহাসের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কান্নার কাব্য।

লেখক: কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস

কলামনিস্ট, প্রজ্ঞা নিউজ, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র